খুলনা ব্যুরোঃ | শনিবার, ১৩ মে ২০২৩ | প্রিন্ট
ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসে জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভেড়িবাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট উপকূলের মানুষ।
ঘূর্ণিঝড় ‘‘মোখা’’ খুলনা উপকূলের দিকে যতই এগিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে শঙ্কা। ঝড়ের প্রভাবে নদ-নদীতে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়লেই দুর্বল ভেড়িবাঁধ উপচে পানি লোকালয়ের প্রবেশের শঙ্কায় রয়েছেন উপকূলবাসী।
উপকূলের বাসিন্দারা বলছেন, দুর্যোগ আসলেই শঙ্কা বাড়ে। ঝড়ে ভেড়িবাঁধ ভেঙে অথবা উপচে প্লাবিত হয় লোকালয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় জলাশয়, ফসলের মাঠ ও ঘরবাড়ি।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় ‘‘মোখা’’র ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে খুলনা উপকূলীয় তিন জেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, পাউবো খুলনার ডিভিশন-২ এর অধীনে কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় ভেড়িবাঁধ রয়েছে মোট ৬৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ৭ কিলোমিটারের ১৮ পয়েন্ট। এরমধ্যে কয়রা উপজেলার দশালিয়া, শিকারীবাড়ি, নয়ানী, মঠবাড়ি, জোড়শিং আংটিহারা, গোয়ালখালী, দাকোপ উপজেলার খোনা, লক্ষিখোলা, আচাবুয়া, বটবুনিয়া বাজার, পাইকগাছা উপজেলার চৌমহনা, মাহমুদকাঠি, বাসাখালী, বয়েরঝাপা, পার বয়েরঝাঁপা এলাকার সাতটি পোল্ডারের ১৮টি পয়েন্টে ৭ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীতে পানি বাড়লে ওই এলাকার বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ উপচে অথবা ভেঙে গিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মোঃ আমিরুল আজাদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আগামী ১৪ মে উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করবে। এর প্রভাবে উপকূলের বিভিন্ন স্থানে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট উপকূলে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আছড়ে পড়ার আশঙ্কা নেই। তবে এর প্রভাবে উপকূলে বৃষ্টি ও বাতাস হতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মোঃ শফি উদ্দিন বলেন, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর ও নড়াইল ৫ জেলায় ১ হাজার ৮৪০ কিলোমিটার ভেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে উপকূলীয় খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা তিন জেলায় মোট ১ হাজার ৪৪২ কিলোমিটার ভেড়িবাঁধ রয়েছে। যার ৮৭ কিলোমিটার ভেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ২৫ কিলোমিটার অতিঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে।
তিনি বলেন, অতি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ মেরামতে কাজ চলছে।
খুলনার কয়রা উপকূলের বাসিন্দারা জানান, তিন দিকে নদীবেষ্টিত কয়রার মূল সমস্যা নদী ভাঙন। যেকোনো দুর্যোগে নদীতে জোয়ারের চাপ বাড়লে কোথাও না কোথাও বাঁধ ভাঙে। ভাঙন রোধে স্থায়ী সমাধানের চেষ্টার পাশাপাশি যারা দুর্দশায় আছেন তাদের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর ভেড়িবাঁধের ভাঙনের কারণে এ এলাকায় অভাব-অনটনে বিপর্যস্ত জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। আবার জীবিকার অন্বেষণে এলাকা ছেড়ে শহর ও নিকটবর্তী জেলামুখী হচ্ছেন কেউ কেউ। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানায় সেবারও বাঁধ ভাঙে এবং সেটি মেরামতের জন্য কর্তৃপক্ষ সময় নেয় ২ বছর। এই পুরো সময়ে বসবাসের জায়গাগুলো পানির নিচে ডুবে ছিল এবং অনেক পরিবারের জন্য বাঁধই ছিল একমাত্র আশ্রয়।
২০১১ সালে বাঁধ মেরামত করা হলে তারা তাদের বাড়ির যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেখানে ফিরে যান এবং আবারো শূন্য থেকে জীবন শুরু করতে বাধ্য হন। তারপর আঘাত হানে ইয়াস। গত ১০ বছরে তারা যতটুকু গড়েছিলেন ইয়াসে তার সবই আবার নোনাপানির নিচে তলিয়ে যায়। এভাবেই চলছে কয়রাবাসীর ভাঙা-গড়ার দুর্বিসহ জীবন।
কয়রার বাসিন্দা নিতিশ সানা বলেন, আইলা, আম্পান ও ইয়াসে ভেড়িবাঁধ ভেঙে ও উপচে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। মাছের ঘের, পুকুর ও ফসলের মাঠ লবণ পানিতে তলিয়েছে, ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আসছে জানতে পেরে উপকূলের মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা বেড়েছে। বিভিন্ন স্থানে স্বেচ্ছাশ্রমে দুর্বল বাঁধ বালু ও মাটি দিয়ে উঁচু করছে।
কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, এখনও ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র তেমন কোন প্রভাব খুলনায় পড়েনি। ওইভাবে নাও পড়তে পারে। তবে জলোচ্ছ¡াসে বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশের শঙ্কা রয়েছে। আমরা দু-দিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছি। উপজেলার প্রায় ১০টি স্থানে বাঁধ ঝুকিপূর্ণ রয়েছে। ৪০ দিনের কর্মসূচি ও স্বেচ্ছাশ্রমে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। সংকেত পেলে মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হবে।
পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগম বলেন, আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তত করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণক্ষ খোলা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ করা হয়েছে। আশা করছি তেমন কোন সমস্যা হবে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, দুর্যোগ কবলিত কয়রার বেড়িবাঁধের ভাঙন রোধে তারা স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করছেন। কয়েক দিনের মধ্যে বাঁধ নির্মাণের জন্য একটি মেগা প্রকল্প শুরু হবে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ঝুঁকি কমবে।
তিনি বলেন, আপাতত বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ অংশের তালিকা করা হয়েছে। কিছু এলাকায় সংস্কারের কাজও শুরু হয়েছে। অন্য জায়গাগুলোতেও কাজ করা হবে।
এদিকে খুলনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘূর্ণিঝড় ‘‘মোখা’’র ক্ষতি এড়াতে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বলেন, জেলার ৪০৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষদের জন্য শুকনা খাবার, পানি, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণকক্ষ। এছাড়া নির্দেশনা অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষার মালামাল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কৃষি, প্রাণী ও মৎস্য বিভাগকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড প্রস্তুত রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য বলা হয়েছে। প্রতি মুহূর্তে ঘূর্ণিঝড়ের গতিবিধি দেখা হচ্ছে। দুর্যোগ পূর্ব সার্বিক প্রস্তুতি আমরা গ্রহণ করেছি।
খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল করিম বলেন, এখনও ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র প্রভাব পড়েনি খুলনায়। তবুও আমরা প্রস্তুত রয়েছি। মানুষকে সচেতন করছি। বিপদ সংকেত পেলে মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হবে।
Posted ৭:১৩ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১৩ মে ২০২৩
dainikbanglarnabokantha.com | Romazzal Hossain Robel
এ বিভাগের আরও খবর
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।