• শিরোনাম

    সমবায় সমিতির নামে গ্রাহক আমানতের অর্ধশত কোটি টাকা গায়েব

    কামরুল মনোহরদী প্রতিনিধি শুক্রবার, ১৫ অক্টোবর ২০২১

    সমবায় সমিতির নামে গ্রাহক আমানতের অর্ধশত কোটি টাকা গায়েব

    apps
    নরসিংদী মনোহরদীতে সমবায় সমিতির নামে গ্রাহক আমানতের অর্ধশত কোটি টাকা গায়েব করে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে শাহ সুলতান সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি নামে একটি এনজিওর বিরুদ্ধে।আবুল কালাম আজাদ নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এই সমিতির উদ্যোক্তা। তিনি জামায়েতী ইসলামীর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।তবে কিছুদিন আগে তাকে সংগঠন থেকে বহিস্কার করা হয়েছে।তিনি নরসিংদীর ঘোড়াদিয়া-সংগীতা রোড, গাজী মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা দেখিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন। টাকার জন্য আমানতকারীরা প্রতিদিনই তালাবদ্ধ সমিতির অফিসে ভিড় জমিয়ে বিক্ষোভ করছেন। জানা যায়, শাহ সুলতান সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি নামে ২০১৩ সালে জেলা সমবায় কার্যালয় থেকে (০০০৪০) রেজিষ্ট্রেশন নিয়ে মনোহরদী উপজেলার খিদিরপুর বাজারে শুরু করে ঋণদান কার্যক্রম। সমিতিটি পুঁজি সংগ্রহের জন্য ব্যাংক সুদের প্রায় দ্বিগুণ মুনাফার লোভ দেখিয়ে এলাকার সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে। খিদিরপুরসহ আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়নের প্রায় ৫শতাধিক গ্রাহকের মাঝে তাদের ঋণ কার্যক্রম চালানো হয়।

    এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন পশ্চিম চরমান্দালিয়া গ্রামের ওসমান মৌলভী, মনতলা ফাযিল মাদরাসার শিক্ষক মুজিবুর রহমান সাহি ও মো. মফিজ উদ্দিন । আলেম সমাজের মানুষ হওয়া স্থানীয় আমানতকারীরা তাদের প্রতি বিশ্বাস রেখে এতে বিপুল পরিমাণে টাকা বিনিয়োগ করে। তারা লাখে মাসিক ১৪শ’ টাকা মুনাফার লোভ দেখিয়ে শাহ সুলতান সমিতিতে টাকা বিনিয়োগ করতে গ্রামের মানুষকে আকৃষ্ট করে। এলাকায় কালাম মৌলভীর সামাজিকভাবে বিশ্বস্ত একটি ভাবমূর্তি রয়েছে। এ বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে ধোঁকায় ফেলা হয় বিনিয়োগকারীদের। এর বিনিময়ে কমিশন বাবদ লাখে মোটা একটি অংক কমিশন ভিত্তিক এজেন্টরাও হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে মুজিবুর রহমান সাহি মৌলভীর সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি জানান, তার মাধ্যমে সমিতিতে টাকা জমা হলেও লাভবান নন তিনি। বরং তার নিজেরই সাড়ে ১৪ লাখ টাকা, তার মাধ্যমে ভাগ্নে মনতলার আশরাফ আলীর ২ লাখ ৫০ হাজার এবং শ্যালিকা কিশোরগঞ্জ শহরের আল আমিনের স্ত্রী রোকেয়ার ৩০ লাখ টাকা সমিতিতে জমা আছে বলে জানান তিনি। আর এভাবেই একটি সঞ্চয় ঋণদান ও সমবায় সমিতির নামে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয় বলে অভিযোগে প্রকাশ পেয়েছে। তবে অভিযুক্ত আবুল কালাম মসজিদে বসে শপথ করে দাবি করেন, এ টাকার কোনো অংকই তার পকেটে যায়নি। সব টাকাই দফায় দফায় নরসিংদীস্থ প্রধান অফিসে জমা হয়েছে। এ সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ আছে কিনা জানতে চাইলে আছে বলে জানান ।

    তবে তা দেখাতে ব্যর্থ হন তিনি। এ টাকার মধ্যে ৬৯ লাখ টাকা এলাকায় ঋণ হিসেবেও বিভিন্ন জনের কাছে রয়েছে বলেও দাবি করা হয়। তিনি আরো জানান, এ অফিসসহ প্রধান অফিসের সব টাকাই বিনিয়োগ হয়েছে নরসিংদীতে শাহ সুলতান নামের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। এ জন্য ১০ কোটি টাকার একটি ব্যাংক লোনও করতে হয়েছে তাদের। প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত লোকসান দিয়ে দিয়ে এখন সেসব পুরোপুরি বন্ধ- বলে দাবি কালাম মৌলভীর। তিনি আরও জানান, এ পরিস্থিতিতে শাহ সুলতানের নরসিংদীস্থ প্রধান অফিসসহ খিদিরপুরস্থ অফিসের বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য টাকা ফেরত দেয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। বিনিয়োগকারীদের কোনো টাকাই এ মুহূর্তে ফেরত দেয়ার উপায়ই তার নেই। তবে তিনি আপ্রাণ চেষ্টায় আছেন প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করে পর্যায়ক্রমে সবার জমাকৃত টাকা ফিরিয়ে দিতে পারবেন। বর্তমান জটিল পরিস্থিতিতে সমিতির এমডি ফারুক মোল্লা গা-ঢাকা দিয়ে পরিস্থিতি আরো জটিল করে দিয়েছে বলেও দাবি তার। তথ্যানুসন্ধানকালে এলাকাবাসীর অনেকেই খোলাখুলিভাবে তাদের সর্বস্বান্ত হবার বর্ণনা দিয়েছেন এ প্রতিবেদককে। তাদের মধ্যে পশ্চিম চরমান্দালীয়া গ্রামের রিয়াজ উদ্দীনের ছেলে ওবাইদুল (২৫) জানান, ওসমান মৌলভীর সক্রিয় প্ররোচনায় সোনালী ব্যাংক রামপুর শাখায় জমাকৃত টাকা থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা তুলে সমিতিতে জমা রাখেন তিনি। বিপরীতে একটি কাঁচা রশিদ ও টাকা উত্তোলনের জন্য ব্যাংকের আদলে একটি চেকবই দেয়া হয় তাকে। আর তা ‘শাহ সুলতান এমসিএস’ নামে অজ্ঞাত একটি প্রতিষ্ঠানের নামে।

    অথচ সমিতির অফিস হিসেবে যে অফিসে টাকা দেন তিনি তার সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা রয়েছে ‘শাহ সুলতান সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি’র নাম। ওবাইদুল আরও জানান, টাকা ফেরত পেতে সমিতি এবং ওসমান মৌলভীর বাড়িতে ধর্না দিয়ে হয়রান হচ্ছেন তিনি। কিন্তু জমাকৃত টাকা আর মিলছে না। ওসমান মৌলভীও এখন আত্মগোপনে। ওবাইদুলদের প্রতিবেশী নাছিমার (২২) কাহিনীও প্রায় অভিন্ন। স্বপনের স্ত্রী নাছিমার জমাকৃত টাকার পরিমান ২ লাখ। আরেক প্রতিবেশী রুমার ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। টাকার শোকে তারা এখন কপাল চাপড়াচ্ছেন। তপন ডাক্তার নামে একজন ভুক্তভোগী জানান, তিনি একাই প্রায় কোটি টাকার মত বিনিয়োগ করেছেন এই শাহ সুলতানে। খিদিরপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের হাজের বেগম জানান, প্রবাসী স্বামীর কষ্টার্জিত সব আয়,মা,বোন ও ভাগিনার কাছ থেকে ১৯ লাখ টাকা এনে সমিতিতে রাখি।

    এই টাকা না পেলে স্বামীর সংসার সব হারাতে হবে আমাকে। কালিরচর গ্রামের তারা মিয়া বলেন, আমার ৭ লাখ,ভগিনার ৭ লাখ,বোন ভগ্নীপতির বরো লাখ,মামা- মামীর তিন লাখ সহ মোট ৩০ লাখ টাকা এই এনজিওতে রাখি। এ ছাড়াও রামপুর গ্রামের উপসহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার তপন কুমার বণিক ও তার পরিবারের এক কোটি পাঁচ লাখ, চরমান্দালিয়া গ্রামের কানন মিয়া ও তার প্রবাসী শ^শুর এবং ফুফার ৩৮ লাখ টাকা, রামপুর গ্রামের আশরাফুল ইসলামের ৩০ লাখ, নয়াপড়া গ্রামের নিপা বেগমের ১০ লাখ, কালিরচরের জনি আক্তারের সাড়ে ৬ লাখ, একই গ্রামের কাউসার মিয়ার ৫ লাখ টাকা, পশ্চিম চরমান্দালিয়া গ্রামের আব্দুস সালামের ৮ লাখ, সুবর্না আক্তারের ৬ লাখ টাকা, আব্দুল কাদিরের ২ লাখ, সোহেল মিয়ার সাড়ে ৪ লাখ, সাবিনা আক্তারের সাড়ে ৪ লাখ, ঝরনা বেগমের ২ লাখ টাকা আমানত রেখেছেন। এ বিষয়ে উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মোঃ ওমর ফারুক জানান, শাহ সুলতান সমবায় সমিতি তালাবদ্ধ করে কর্মকর্তারা পালিয়ে গেছে বলে জানতে পেরেছি।আমাদের কাছে এখন ও কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি। মনোহরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এএসএম কাশেম বলেন বিষয়টি খিদিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে জানতে পেরেছি।উপজেলা সমবায় কর্মকর্তাকে সমিতি পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

    বাংলাদেশ সময়: ৫:৩৪ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ১৫ অক্টোবর ২০২১

    dainikbanglarnabokantha.com |

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    আর্কাইভ