• শিরোনাম

    পাটজাত সামগ্রী তৈরি করে ১৯৭৬ সাল থেকে স্বাবলম্বী হচ্ছে চুুয়াডাঙ্গার মিশন পল্লীর নারী-পুরুষ

    রিফাত রহমান, চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি : মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই ২০২৩

    পাটজাত সামগ্রী তৈরি করে ১৯৭৬ সাল থেকে স্বাবলম্বী হচ্ছে চুুয়াডাঙ্গার মিশন পল্লীর নারী-পুরুষ

    apps

    পাটজাত সামগ্রী তৈরি করে ১৯৭৬ সাল থেকে স্বাবলম্বী হচ্ছে চুুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা খৃস্টান মিশন পল্লীর নারী-পুরুষ। এই তৈরি পণ্য যাচ্ছে বিদেশে। প্রত্যেকদিন কাজের অবসরে এ পল্লীর বাসিন্দারা চাহিদা মত পাটের সামগ্রী তৈরিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন। তারা দিনের অবসরের পুরোটাই ব্যয় করছেন এ কাজে।

    কার্পাসডাঙ্গা খৃস্টান মিশন পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, ড্যানিয়েল মন্ডল মন্টুর স্ত্রী মহিলা সমিতির সম্পাদিকা বুলবুলি মন্ডল (৭০) তার বাড়ির সরু বারান্দায় বসে কার্পেটের অংশ বিশেষ তৈরি করছেন। ৪৭ বছর এ কাজে যুক্ত রয়েছেন তিনি। ২৫০ টাকা মন দরে যে পাট তিনি আগে কিনেছিলেন তা এখন ৪ হাজার টাকা মন দরে কিনতে হচ্ছে। কিন্তু থেমে নেই তার কাজ। চাহিদা মত সামগ্রী বানিয়েই চলেছেন তিনি। অবসর সময় অন্য কাজে ব্যয় করতে তিনি নারাজ। পাশের বাড়ির সৌম মন্ডল (৬৭) তিনিও একই বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন এ কাজ। গ্রাহকের চাহিদা মত তাদের পণ্য বানিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে কাজ করছেন তারা।

    বুলবুলি মন্ডল ও কর্মী সীরা মন্ডল জানালেন, ৩০০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৮০ সেন্টিমিটার চওড়া, ২০০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৮০ সেন্টিমিটার চওড়া, ৫২০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ২৯০ সেন্টিমিটার চওড়া কার্পেটসহ চাহিদা মোতাবেক পাট দিয়ে তৈরি করা হয় টেবিল ম্যাট, ঘরের আড়াই টাঙ্গানো শিকি ও তার ভেতরকার বাক্স, পাখি, মাছ, মেয়েদের ব্যবহৃত হাত ব্যাগ, বালতি, ফুলদানী,জায়নামাজ ইত্যাদি। পাট দিয়ে তৈরি একটি কার্পেট ও ম্যাটের টুকরো টুকরো অংশ জুড়ে পরিপূর্ণরূপ আনা লাগে। কর্মীদের দিয়ে ওই অংশ গুলো তৈরি করে নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী তাদের টাকা পরিশোধ করা হয়। ১২ সেন্টিমিটার লম্বা ও চওড়া ৬ সেন্টিমিটার কার্পেট তৈরি করতে ১টি তৈরি করা টুকরার মজুরী পড়ে ৭৭ টাকা, ছোট ৪ কোনা তৈরি করা হয় প্রতি টুকরা ২৭ টাকা মজুরী দরে, ৩ কোনা তৈরি করা হয় প্রতিটি ৭৬ টাকা মজুরী দরে, পাঁচ ও ছয় কোনা কোনা তৈরি করা হয় প্রতিটি ৬২ টাকা মজুরী দরে ও শেষের অংশ ২টি সেলাই করা হয় ৪০০ টাকা মজুরী দরে। তারপর রঙ করে গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করা হয়। কর্মীরা এই অংশ গুলো যে যত তৈরি করতে পারবে সে তত টাকা রোজগার করতে পারবে। কাজের অবসরে এ কাজ করে একজন কর্মী প্রতি মাসে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা রোজগার করতে পারছেন।

    ওই পল্লীর কর্মী চাইনা মন্ডল জানান, আমরা একেক জন একেকটি কাজ করি। আমরা আমাদের মিশন থেকে চাহিদা মত পাট কিনে আনি। ওই পাট ভালভাবে প্রস্তুত করে পাটের কাজ করতে হয়। ৮ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে কাজের অংশ জমা দিই। জমা দেয়ার পর পারিশ্রমিকের অংশ থেকে পাটের টাকা কেটে নিয়ে মজুরী দেয়া হয়। তাতে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা রোজগার করা যায়।

    কর্মী সীরা মন্ডল বলেন, ১৯৭৪ সালে বিয়ের পর তারা আলাদা হয়ে যায়। শশুরকুল থেকে কোন সহযোগীতা পায়নি। তার স্বামী শ্রমিক হিসেবে কাজ করত। তাতে সংসারের টানাটানির শেষ ছিলনা। সেই টানাটানি কাটিয়ে ঊঠাতেই তিনি পাট দিয়ে তৈরি হস্তশিল্পের কাজ শুরু করেন। এই কাজ করে তিনি তার দু’ছেলে মেয়েকে ভাল জায়গায় নিয়ে গেছেন। মেয়ে নাসিংয়ে পড়াশুনা শেষ করে সে সরকারী চাকরি করছে। ছেলে ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। তিনি আরো বলেন, আমি বর্তমানে স্বাবলম্বী। কিন্তু এ কাজ ছাড়েনি। তিনি বলেন, এ কাজে ছেলের স্ত্রী কে তিনি যুক্ত করেছেন। হস্তশিল্পের এ কাজ করে তিনি প্রায় ৪ মাস পর পর ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করেন।

    কর্মী স্বপ্না মন্ডল বলেন, বছর দুয়েক হলো তিনি এ কাজে শুরু করেছেন। প্রথমে কষ্ট মনে হলেও এখন ভালই লাগে। কাজ শেষে যখন হাতে টাকা আসে তখন কষ্ট আর কষ্ট মনে হয়না। ওই ঊপার্জিত টাকা দিয়ে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়াসহ সংসারের ছোটখাট কাজ করতে পারছি।

    খৃস্টান মিশন পল্লীর বুলবুুলি জানান, ১৯৭৬ সাল থেকে মেহেরপুুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার খৃস্টান মিশনারীর মাধ্যমে এ কাজ গুলো করানো হয়। এর আগে ইটালী থেকে কার্পসডাঙ্গায় ধর্ম প্রচার করতে আসেন ফাটার জন। তিনিই তাদের এ কাজে সংপৃক্ত করেন। সড়ক দূর্ঘটনায় তার মৃত্যু হলেও এ কাজ থেমে যায়নি। চাহিদা মত বিভিন্ন রকম কাজ করতে হয়। এ কাজে প্রয়োজনীয় শুকনো পাট ফরিদপুর ও গোপলগঞ্জ জেলার মকসুদপুর উপজেলার বানিয়ারচর ও খুলনা থেকে সংগ্রহ করা হয়। আগে মন প্রতি ২ ৮াজার ৮০০ টাকা দরে পাট গুলো কেনা পড়ত। এখন লাগে মন প্রতি ৪ হাজার টাকা। বিভিন্ন বেইজে ৫০ জন নারী-পুরুষ এ কাজ করত। কিন্তু এখন কাজের মানুষ কমে এসেছে। অভাব-অনটন থাকায় আগে এ কাজ করার জন্য মানুষের অভাব ছিলনা। এখন অভাব ঘুঁচিয়ে প্রায় সকলেই স্বাবলম্বী হয়ে যাওয়ায় কাজের মানুষ কমে গেছে। তবুও কাজ থেমে নেই। এখান থেকে তৈরি করা পাটজাত পণ্য সামগ্রী দেশে চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে যায় বলে তিনি জানান। সরকারী বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এত বছর কাজ করে পারিশ্রমিকের একটি টাকাও তাদের মার যায়নি। যদি অন্য কোন সংস্থার সঙ্গে আমরা কাজ করতে যায় তাহলে পারিশ্রমিক মার যাওয়ার সম্ভবনা থকে। এ কারনেই এটা আমরা করিনা। আমরা আমাদের খৃস্টান বেইজের মাধ্যমে যথাযথভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

    কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল করিম বিশ্বাস বলেন, দেশের জাতীয় সম্পদ পাট। পাট দিয়ে ১৯৭৬ সাল থেকে কার্পাসডাঙ্গা মিশন পল্লীতে যে পণ্য গুলো তৈরি হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে তা প্রশংসার দাবীদার। সরকারীভাবে এ কাজের পৃষ্টপোষকতা না থাকার কারনে এর বিকাশ ঘটছেনা। এ পল্লীতে হস্তশিল্পের কাজ ভাল পরিবেশে করার জন্য সেড নির্মাণ করা হবে। তিনি দাবী করেন, সরকারী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরো নারী-পুরুষকে এ কাজে সংপৃক্ত ঘটালে এলাকার বেকার সমস্যা লাঘব হবে।

    চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোকসানা মিতা বলেন, কার্পাসডাঙ্গা মিশন পল্লীতে বিশেষ করে মেয়েরা পাটজাত দ্রব্য ব্যবহার করে যে পণ্য তৈরি করছেন তা প্রশংশনীয়। এ পর্যন্ত এ হস্তশিল্পের সম্প্রসারণ ও বিকাশ ঘটানোর জন্য তারা কোন সরকারী সাহায্য সহযোগীতা চাইনি। তারা যদি সহায়তা চাই তা অবশ্যই করা হবে।

    বাংলাদেশ সময়: ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই ২০২৩

    dainikbanglarnabokantha.com |

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    আর্কাইভ