রবিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

>>

নারীর মুক্তি: সমাজ ও সাহিত্যের আঙ্গিকে

ড. এ এইচ এম মাহবুবুর রহমান   |   বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫   |   প্রিন্ট


নারী যুগে যুগে উন্নয়নের শিরোনাম হয়েছে সমাজ ও সাহিত্যের আলোচনায়। বাস্তবে নারীর মনোসামাজিক, অর্থনেতিক পরিবর্তনের জন্যে কোনো উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম সমাজ বা সাহিত্যে তো দূরে থাক দৃশ্যমান কর্মসূচিতে পরিদৃষ্ট হয়নি। নারীকে বস্তগত উপাদান হিসেবে ভোগ-বিলাসের, বিনোদনের সামগ্রী হিসেবে গণ্যকরা হয় সর্বৈবে। বর্তমান মুক্তবাজার অর্থনীতির বহুমুখিন দরোজা উন্মুক্ত করণের মাধ্যমে নারী আর শুধু ব্যক্তি হিসেবে নয় পণ্য হিবেবে গণ্য হচ্ছে বিশ্ব মানচিত্রের সবগুলো মহাদেশে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে পরিমিত বা নিয়ন্ত্রিত রেখা দিয়ে বিচ্ছিন্ন থাকার চেষ্টা করেও পারবে না। অর্থনীতি যখন বস্তুর গুণ নির্ণয়ের নিয়ামক তখন সামাজিক মূল্যবোধ বা ঐতিহ্যের ঘেরাটোপে নারী ইচ্ছে করলেও নিজেকে দমিত রাখতে পারে না। তাকে ঘর থেকে বের হতেই হবে। উন্নয়নের পরিবর্তনের সঙ্গে অর্ন্তগত হতে হবে। এটাই আজকের সময়ে গ্লোবালাইজেশন। গ্লোবের সঙ্গে আবর্তিত হওয়া। কিন্তু নারীর জন্য কতোটা মসৃন উন্নয়েনর গোলার্ধে যুক্ত হওয়া তার প্রশ্ন থেকেই যায়। সাহিত্যে নানাভাবে নারী চরিত্র চিত্রিত হয়েছে। মহাকাব্য থেকে সমসাময়িক উপন্যাসে। এসব সাহিত্যেও নারীকে সামর্থবান, ব্যক্তিত্ববান বা সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহনে ক্ষমতা দেয়া হয়নি। তার কিছু দৃষ্টান্ত দেয়া হলো-

খ্রীষ্টপূর্ব পাঁচশত বছর পুর্বে নারীর মুক্তি ছিল পুরুষের ইচ্ছেনির্ভর। মহাকাব্য রামায়নের একটি নারী চরিত্র সীতা কিংবা মহাভারতের দ্রৌপদির চিত্র নারী প্রগতীর পক্ষে চিত্রিত হয়নি। না অর্থনীতি না মনোসামাজিক ভাবে। বাল্মিকী চায়নি সীতা আপন মহিমায় ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক। রামের ইচ্ছেমতো বার বার সীতাকে সতিত্বের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে। শেষে অপমান সহ্য করতে না পেরে পাতালে চলে গেছেন মায়ের কাছে। তাছাড়া সীতার আর যাওয়ার জায়গা ছিল না। সীতা যে পুরুষের ভোগ্যপন্য ছিল তা তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ প্রমাণ দেয়। পৃথিবীতে যত যুদ্ধ বিগ্রহের কারণ তা বস্ত অথবা পণ্যের জন্য। সীতা কি রাবনের কাছে ভোগ্য পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়নি রামায়নে? সীতা সুন্দরী ছিল। তাকে রাবনের চাই। যে কোনো মুল্যে। শেষে যুদ্ধ।
মহাভারতের দ্রৌপদি। পঞ্চপান্ডবের স্ত্রী। পাশা খেলায় স্মামীর বাজীর শিকার হয়েছেন দ্রৌপদি। বস্ত্রহরণের মতো অপমান তাকে সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু দ্রৌপদি তো সীতা নন। তিনি প্রতিবাদ করেছেন। তবু মুক্তি মেলেনি। রাজ্যস্তুত হয়েছেন। সমাজ তাকে বহুগামীনী উপাধী দিয়েছে । নারীর মুক্তি কোথায়। মহাভারতে নারীর মতামতের গুরুত্ব চিত্রিত হয়নি। কালীদাশের শকুন্তলা। সে এক লাবন্যময়ী নারী। পুষ্পলতার মতো কোমল। বনলতা। অবলা শকুন্তলা রাজা দুস্মন্তের প্রণয়বাণের শিকার হয়ে নিজে স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সন্তানের পরিচয় নিয়ে রাজদরবারে হাজির হলে রাজা অস্বীকার করেন। শকুন্তলা মিথ্যে বলছে বলে প্রতিপন্য হয়েছে। শকুন্তলার সন্তান রাজা দুস্মন্তের না। অপমান গ্লাণী সহ্য করতে হয়েছে শকুন্তলাকে। মাতৃত্বের পরিচয় উপেক্ষিত হয়েছে রাজ দরবারে। যখন পরিচয় মিলেছে তখন শকুন্তলার জন্য সে পরিচয় সুখকর ছিল না।

রবীন্দ্রনাথের কুমুদিনি। সন্তানের জন্যে কুমুদিনিকে স্মামী মধুসুদনের অপমান সহ্যকরেও ঘরে ফিরতে হয়েছে। পরিবার থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন যোগাযোগের নায়িকা কুমু। মানুষ হিসেবে নিজের স্বাধীনতা আর মুক্তি কুমুকে বাড়ী থেকে বের করে নিয়েছিল। কিন্তু ঘরের বাইরে থাকতে পারেন নি। ‘স্ত্রির পত্রে’র নায়িকা মৃণাল পেরেছিলেন ঘর থেকে বাইরে থাকতে। মুক্ত আকাশ আর বুক ভরে নিশ্বাস নেবেন বলে। ঘর থেকে মুক্তি নিয়ে ব্যক্তিস্বত্ত্বা টিকিয়ে রাখতে কাশী চলে গেছেন মৃণাল। নারীর স্বাধীনতা উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

তিনহাজার বছর আগে হোমারের হেলেন। ঈলিয়াডের নায়িকা। সৌন্দর্যের জন্য যুদ্ধের উপলক্ষ হয়েছেন। ট্রোজান আর গ্রীসের মধ্যে বছরের পর বছর যুদ্ধ চলেছে হেলেনের জন্য। স্পর্টার ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছে দীর্ঘ যুদ্ধের লেলিহান শিখায়। নারী হিসেবে হেলেন নিজেকে অভিশপ্ত ভেবেছে। কিন্তু পুরুষের লালসা থেকে মুক্তি পান নি। হেলেনের নিজের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। এক কন্যা সন্তানের মা তিনি। মেনেলাউসের স্ত্রী। পরিবারের সদস্যদেও নিয়ে সুখেই ছিলেন। কিন্ত সমস্যায় পড়েছেন সে সুন্দরী। লাবন্যময়ী। এটাই তার ধ্বংসের কারণ। সাতাশ জন প্রেমিক তার। সবাই তাকে চায়। তাহলে হেলেন কি পণ্য নয়? নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতাই যেখানে ভূলুণ্ঠিত সেখানে তার উন্নয়নের প্রশ্ন আসে কোত্থেকে। হেলেন একজন নারী তাকে নিয়েই হোমার মহাকাব্য লিখেছেন। ঈলিয়াডে নারীর ন্বাধীনতা মেলেনি। উন্নয়ন তো আরো দূরের ।

হেনরিক ইবসেনের নোরা। ‘এ ডলস্ হাউজ’ নাটকের নায়িকা। সংসারের বন্দি জীবনের গ্লানী থেকে একটু মুক্তির জন্যে হাহাকার করেছে নোরা। সংসারে পুতুলের মতো বাস করতে হয় নোরাকে। ব্যক্তি হিসেবে তো নয়ই নারীর কোনো মুল্য পায় না নোরা। শেষ পর্যন্ত সংসার থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মানুষ হিসেবে বাঁচার জন্যে । যুগে যুগে নারীর এই মুক্তি নারীকে হয় আত্মহত্যার পথ বাতলে দিয়েছে নয়তো সংসার থেকে পালাতে হয়েছে । ইবসেনের নোরার মতো। কিন্তু নারীর কোনো মুক্তি আসেনি।

টলস্টয়ের আন্না কারেনিনা। উপন্যাসের নায়িকা আন্না একটু স্বাধীনতার জন্য আত্মহত্যাই করেছে। স্বামী নামক পুরুষের জীবন থেকে মুক্তির জন্যে। সমাজের কাছে নিজেকে অভিশপ্ত মনে করেছে। সমাজ আন্নাকে রক্ষা করতে পারেনি। আন্নার পাশে দাঁড়ায় নি সমাজের সংহতি, সমবায় চিন্তার সামাজিক প্রতিষ্ঠান। আন্না স্মামী সংসারে থেকেও প্রেমে পড়েছিলেন। তার কিছু করার ছিল না। যখন ভেবেছে তার এসব ঠিক হচ্ছে না তখন সে আত্বহত্যা করেছে। নিজেকে মুক্ত করার আর কোনো পথ খোলা ছিল না।

ফ্রান্সের গুস্তাভ ফ্লবেয়ার যত্ন করে নির্মাণ করেছিলেন তার মাদাম বোভারি উপন্যাসের নায়িকা এমাকে। কিন্তু চিকিৎসক স্বামীর কাছে শান্তি সুখ স্বাধীনতা পান নি এমা। মাদাম বোভারী যন্ত্রণা ক্লিষ্ট জীবন থেকে পালাতে গিয়ে প্রেম করেছেন। কিন্তু সুখ মেলেনি। আত্মহত্যাই তাকে নিয়ে গেছে সুখের অতলান্তে।
সমাজ ও সাহিত্যে নারীর জীবন বিশ্লেষণ করলে বিশ্ব নন্দিত অনেক চরিত্রের সমাবেশ ঘটানো যাবে। কিন্তু নারী উন্নয়নের দৃষ্টান্ত মেলানো উপন্যাস নাটক কিংবা মহাকাব্য পাওয়া কষ্টসাধ্য। নারীকে চিত্রিত করা হয়েছে পুরুষের অধস্তন হিসেবে। নারীর নিজস্বতা স্বকীয়তা আত্মনির্ভরতার উদাহরণ সমাজ সংসারে অনুল্লেখ্য। কার্ল মার্কস নারীকে দেখেছেন শ্রেণী হিসেবে। শ্রমের মালিক ছাড়া কিছু নয়। এঙ্গেলস নারীকে দেখেছেন ঘর কন্যার প্রিয়তম নারী হিসেবে। ফ্রয়েড় নারীকে দেখেছেন যৌনতার অনুষঙ্গ হিসেবে। সফোক্লিস নারীর মনো বিকারের ইডিপাস কম্লেক্স ব্যাখ্যা করেছেন। মিল্টনের নারী ছিল পাপী সমাজচ্যুত হিসেবে চিত্রিত। শেক্সপিয়রের নারীরা স্মামী ভক্ত হয়েও নারীর সম্মান পায়নি সংসারে। লেডি ম্যাকবেথ, হ্যামলেটের অফেলিয়া এমন অনেক চরিত্র উল্লেখ করা যায়। সাহিত্যে উপেক্ষিত নারী চরিত্র যেমন উপেক্ষিত সমাজেও নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছে নারী যুগে যুগে।

বিশ্ব নারী চিন্তাবিদদের নিরলস গবেষণা আর উন্নয়নের নানা তত্ত্ব নারীর মৌলিক মুক্তি নিশ্চিত করতে পারেনি। মেরি ওলস্টোনক্রাফট, ভার্জিনিয়া উলফ, সিমোন ডি বোভোয়র, সিলভিয়া প্লাথ প্রমুখ নারীবাদি লেখিকা নারী উন্নয়নের তত্ত্ব দিয়েছেন। গবেষণা করেছেন। কিন্তর আত্বিক ও মানসিক পরিবর্তনের পথ সুগম হয়নি। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া নারী উন্নয়ন অসম্ভভ। নারীর উন্নয়নের জন্য নারীর নিজস্ব চিন্তার পরিবর্তন না ঘটলে নারী উন্নয়ন তাত্্িবক বিশ্লেষণের বিষয় হিসেবেই থেকে যাবে।

লেখকঃ ড. এ এইচ এম মাহবুবুর রহমান,  শিক্ষক, জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Facebook Comments Box

Posted ২:০০ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

dainikbanglarnabokantha.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

রূপা
(1776 বার পঠিত)
ছোটগল্প (দেনা)
(1224 বার পঠিত)
দূর দেশ
(1158 বার পঠিত)
কচু শাক চুরি
(1083 বার পঠিত)
কৃষ্ণ কলি
(1041 বার পঠিত)

সম্পাদক

রুমাজ্জল হোসেন রুবেল

বাণিজ্যিক কার্যালয় :

১৪, পুরানা পল্টন, দারুস সালাম আর্কেড, ১১ম তলা, রুম নং-১১-এ, ঢাকা-১০০০।

ফোন: ০১৭১২৮৪৫১৭৬, ০১৬১২-৮৪৫১৮৬, ০২ ৪১০৫০৫৯৮

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

design and development by : webnewsdesign.com

nilüfer escort coin master free spins