• শিরোনাম

    বরেণ্য আইনজীবী-প্রশাসক-রাজনীতিবিদ এঁর জন্মদিন

    অনলাইন ডেস্ক সোমবার, ২৬ অক্টোবর ২০২০

    বরেণ্য আইনজীবী-প্রশাসক-রাজনীতিবিদ এঁর জন্মদিন

    apps

    সাখাওয়াত জামিল সৈকত: ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা একটি শ্রোতা জরিপের আয়োজন করেছিলো। বিষয় ছিলো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? সেই জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে মনোনীত হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

     

    তিনি ছাড়া বাকি ১৯ জনের ধারাবাহিক তালিকা এসময়ে প্রকাশিত হয়। এই বিশ জনের সবার জন্ম ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে। খেয়াল করলে দেখবেন বাঙালি জাতির মাঝে যাঁরা মহান, মেরুদণ্ডী আর স্বনামধন্য তাঁদের বড় অংশের জন্ম ঔপনিবেশিক শাসনামলে।

     

    আপনার প্রিয় রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, চলচিত্রকার, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ, সাঁতারু, ম্যাজিশিয়ান এবং আরও অনেকে জন্মেছেন সেই ঔপনিবেশিক শাসনামলে। যদিও সুযোগ পেলেই সে সময়কে আমরা “ঔপনিবেশিক” বলে গালি দেই।

     

    আজ থেকে ১৪৭ বছর আগে আজকের এই দিনে প্রাচীন বরিশাল জেলার সাতুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবুল কাসেম ফজলুল হক। অধুনা ঝালকাঠি জেলার সাতুরিয়া তাঁর নানাবাড়ি আর বরিশাল জেলার বানারীপাড়া তাঁর পৈতৃক নিবাস। তাঁর পিতা বরিশালের বিশিষ্ট আইনজীবী কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ ছিলেন অবিভক্ত বাংলার ষষ্ঠ মুসলিম গ্রাজুয়েট।  ১৪৭ বছর পর বানারীপাড়ার চাখার ইউনিয়নে গেলে আপনার বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে এত আগে এখানকার এক মুসলিম তরুণ গ্রাজুয়েট হতে কোলকাতা গিয়েছিলো! অবিশ্বাস্যই ঠেকবে।

    অবিভক্ত ভারতবর্ষের সৌভাগ্যই বলতে হয় যে এমন সন্তান জন্ম দিতে পেরেছে। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাধর, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ও দূরদর্শী মানুষ। আর ছিলেন ভীষণ সাহসী ও জেদী।

     

    প্রায় ১৪০ বছর ধরে তাঁর শিক্ষাজীবন ঈর্ষণীয়। রেকর্ডে রেকর্ডে ভরে তুলেছেন তাঁর জীবন। বরিশাল জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা মানে আজকের এসএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগের মুসলিমদের মাঝে প্রথম স্থান লাভ করেন ১৮৮৯ সালে। অভূতপূর্ব স্মৃতিশক্তির অধিকারী এই মনীষী ১৮৯৩ সালে কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিত, রসায়ন ও পদার্থ এই তিন বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে অনার্সসহ স্নাতক পাশ করেন। এরপর ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর করতে গিয়ে বন্ধুর মশকরার জবাব দিতে জেদ করে গণিত এবং ইংরেজি এই দুই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর আবার রিপন কলেজ থেকে আইন বিষয়ে বিএল পাশ করেন ১৮৯৭ সালে। মানে ৪ বিষয়ে অনার্স আর দুই বিষয়ে মাস্টার্স।

     

    পাশ করে পিতার মতো আইন পেশায় নিয়োজিত হন। হলেন কোলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনজীবী স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এর শিক্ষানবিশ।  এদিকে পিতার মৃত্যুর পরে বরিশাল ফেরত আসলেন। বরিশাল বারে যোগদান করলেন। খুব বেশি মন টিকছিলো না।

     

    যোগ দিলেন ব্রিটিশ প্রশাসনে। অনেকেই জানেন না যে শেরে বাংলা ১৯০৬ সালে ঢাকা কালেক্টরেটে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ময়মনসিংহ কালেক্টরেটে কাজ করে পরবর্তীতে জামালপুর মহকুমার মহকুমা প্রশাসক হিসেবে কাজ করেন।

     

    বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পরে তিনি চাকুরি ছেড়ে আইন ব্যবসা ও বরিশালের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। বরিশাল পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯১৩ সালে রবিঠাকুর যেবার নোবেল পুরস্কার পেলেন তিনি তখন বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য হন, মাত্র ৩৯ বছর বয়সে।

     

    তিনি সাহিত্য আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। বরিশালে তিনি “বালক” নামক কিশোর পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এরপর তার যুগ্ম সম্পাদনায় “ভারত-সুহৃদ” নামক পত্রিকা বের হতে থাকে। তাছাড়া তিনি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত নবযুগ পত্রিকার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

     

    তিনিই একমাত্র ভারতীয় যে ১৯১৯ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। এছাড়া তিনি নিখিল ভারত খেলাফত আন্দোলনেরও সম্পাদক ছিলেন।

     

    অবিভক্ত বাংলার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি ১৯২৪ সালে বাংলার শিক্ষামন্ত্রী, ১৯৩৫ সালে কোলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির মেয়র, ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পূর্ববঙ্গের এক নদীবিধৌত গ্রামের মুসলিম ছেলে যে এতদূর যাবেন তা বোধহয় তার শিক্ষিত পিতাও কল্পনা করেননি।

     

    বাংলা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। কোলকাতা তখন ব্রিটিশ রাজের রাজধানী। সে সময়ের আন্তর্জাতিক ও দেশীয় রাজনীতির ঘূর্ণিজল ও কট্টর সাম্প্রদায়িক প্রেক্ষাপটে বাঙাল মুল্লুকের গরু খাওয়া এক মুসলিম হলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী! শেরে বাংলা তিলে তিলে অর্জন করেছেন সবকিছু। তার কোনো পীর ছিলোনা। কারও দানে কিছু অর্জনও করেননি।

     

    যেমন ১৯২৪ সালে শিক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি স্রোতের বিপরীতে রাজনীতি করা শুরু করলেন। এ বছর তিনি নিখিল বঙ্গ প্রজা সম্মেলন করে মেহনতি মানুষের রাজনীতি করা শুরু করলেন। যা পরবর্তীতে কৃষক প্রজা পার্টি-তে পরিণত হয়। আগে রাজনীতি ছিলো রাজা আর রাজন্যদের স্বার্থ রক্ষার কারবার। ভারতে এই প্রথম কেউ প্রজাদের স্বার্থরক্ষার রাজনীতি শুরু করলেন। শেরে বাংলাকে যে বাংলার মানুষ প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন তা শুধুশুধু বানায়নি। তিনি সেই আস্থা অর্জন করেন।

     

    সেই আস্থার প্রতিদানও তিনি দিয়েছেন। তাঁর জীবনের মূল স্বপ্ন ছিলো জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার থেকে কৃষকদের রক্ষা করা। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় “মহাজনী আইন, ১৯৪০” ও “বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন” পাশ হয়, গৃহীত হয় বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ কার্যক্রম। এসব সাহসী পদক্ষেপের জন্য ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার ও বাংলাদেশ তাঁর কাছে ঋণী।

     

    প্রত্যেক মানুষের জীবনের একটা নিজস্ব লক্ষ্য থাকে। আমার ধারণা শেরা বাংলার প্রশাসনের চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে আসার মূল কারণ তৎকালীন শাসনব্যবস্থায় হতদরিদ্র কৃষকদের মুক্তি অর্জন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে সক্রিয় রাজনীতি ছাড়া এই মুক্তি অর্জন কোনোদিন সম্ভব নয়।

     

    ১৯৪৭ এ ভারতভাগের সময় তার বয়স ৭৪। জীবনের সোনালি সময় পেরিয়ে বার্ধ্যকে উপনীত হয়েছেন তখন। এরপর অন্ধকারাচ্ছন্ন পাকিস্তান পর্বেও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদে নিয়োজিত ছিলেন। অবশেষে ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল  পরলোকগমন করেন বহুমুখী প্রতিভাধর রাজনীতিবিদ ও সমাজ সংস্কারক শেরে বাংলা এ কএ ফজলুল হক।

     

    শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ঘটনাচক্রে আমার স্কুলের বড় ভাই এবং প্রশাসন সার্ভিসের সিনিয়র স্যার।

    ১৪৭তম জন্মবার্ষিকীতে এই মনীষীর প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।

    বাংলাদেশ সময়: ৯:০০ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৬ অক্টোবর ২০২০

    dainikbanglarnabokantha.com |

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    রূপা

    ২৪ অক্টোবর ২০২০

    নায়িকা হয়েও কবি ছিলেন

    ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

    ছোটগল্প (দেনা)

    ২৫ জুলাই ২০২১

    আর্কাইভ