• শিরোনাম

    ১৯৭১ সালের আগে আমরা পরাধীন ছিলাম

    অনলাইন ডেস্ক শুক্রবার, ২৬ মার্চ ২০২১

    ১৯৭১ সালের আগে আমরা পরাধীন ছিলাম

    apps
    নূরুদ্দীন দরজী:
    ১৯৭১ সালের আগে কখনোই আমাদের ছিলনা পূর্নাঙ্গ স্বাধীনতা। কোন না কোন ভাবে নিস্পেষণ ও শোষণের যাতাকলে নিস্পেষিত হতে হতো আমাদের। পূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ পাইনি। বাঙালি এবং বাংলাদেশের দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্ৰামের ইতিহাসে ১৯৭১ আমাদের জন্য এনেছে মুক্তির স্বাদ। আমরা পেয়েছি পূর্নাঙ্গ স্বাধীনতা। পেয়েছি স্বাধীনভাবে চলার অধিকার। অবসান হয়েছে বিদেশি বেনিয়াদের শোষণ, জুলুম আর চরম নির্যাতনের পথ। ৭১ এ আমরা পেয়েছি সকল অধীনতার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি। হাজার বছরাধিকালের বিবেচনায় ৭১ সালে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
    এ বছর বাঙালি জাতি তাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে। স্বাধীনতার অর্থ কি একথা নিশ্চয়ই সবাই বুঝতে পারেন। স্বাধীনতা নিজেদের অস্তিত্বের কথা বলে। কোন ব্যক্তি বা জাতির অস্তিত্ব যদি না থাকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানো যায়না। স্বাধীনতাহীনতায় অন্যের অধীনে চলতে হয়। উপনিবেশিক শক্তির অধীনে  নিজেদের আত্মমর্যাদা বলতে কিছুই থাকেনা। স্বাধীনতায় থাকে একটি জাতি, একটি দেশ একটি রাষ্ট্র। স্বাধীন দেশে জনগণ থাকে তাদের নিজেদের শাসনে। জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে দেশের জনগণ সুশাসনের আশায়। জনগণ নিজেদের কথা নিজেরাই চিন্তা করে। আর এর ব্যত্যয় ঘটলেই বলা চলে আসে পরাধীনতার গ্লানি, পরাধীনতা।
    পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালি একটি সুমহান জাতি। জনসংখ্যানুপাতে আমাদের অবস্থান কোনক্রমেই অন্য কোন জাতির  চেয়ে পিছিয়ে নেই। বাঙ্গালির রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা এবং আভিজাত্যতা। বাংলার রয়েছে ঐশ্বর্যশালী অর্থনীতি, বিশাল শস্য ভান্ডার। আমাদের বাংলা সুজলা, সুফলা শস্য শ্যামলা এক ছায়াবীথি। এখানে মাটিতে সোনা ফলে। বাংলার ঐশ্বর্য ও ধন সম্পদের লোভে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতির দশ্যূরা  বাংলাকে করায়ত্তে আনতে চেষ্টা করেছে। আমাদেরকে স্বাধীন ভাবে চলার ও বসবাস করার মূলে নির্লজ্জ আঘাত করেছে। অন্যায়ভাবে এ দেশের নিরীহ মানুষের উপর জুলুম নির্যাতন করে পরাধীনতার শৃঙ্খল পরিয়েছে।
     দীর্ঘ দিনের ইতিহাস পর্যালোচনার সামান্য দিক উ্যঘাটন করলে দেখা যায় বাংলাদেশ, এদেশের মানুষ নিজেদের যা কিছু ছিল তাই নিয়ে স্বাধীন ভাবে চলার চেষ্টা করেছে বার বার। নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করেছে ও স্বাধীন হয়েছে। আবার সে সমস্ত স্বাধীনতা বিপর্যস্ত ও হয়েছে। এমন সব ইতিহাস থেকে জানা যায়, অনেক আগে ৫৯৪ খিষ্টাব্দে শশাঙ্ক নামে একজন শক্তিশালী রাজা বাংলাদেশে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর রাজ্য  ছিল বর্তমান পশ্চিম বাংলার গৌড় নিয়ে। অনেক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে শক্তহাতে তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন। তাঁকে অত্যাচারী রাজা বলা হলেও বাংলাদেশে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার তিনি প্রবর্তক।
    শশাঙ্ক এর অনেক পর ১৩৩৬ সালে বাংলাদেশে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ। অন্যদিকে প্রায় এক‌ই সময় পশ্চিমবঙ্গে  ও স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন আলাউদ্দিন আলী শাহ । সব চেয়ে বিশ্ময়কর ব্যাপার ছিল, এ দুই বাংলাকে একত্রিত করে একটি স্বাধীন বাংলা ঘোষণা করে রাজ্য স্থাপন করেন শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ। তিনি এবং তাঁর বংশের শাসকগণ স্বাধীন ভাবে বাংলা শাসন করেছেন। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ ও ছিলেন ঐ বংশীয় একজন সুশাসক। তাঁর আমলে শৌর্যবীর্যে  ধন সম্পদে এ দেশের প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। এ বিচক্ষক সুলতানের শাসনের কথা আজও কেউ কেউ বলে থাকেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, নিজেদের মধ্যে কলহ বাঁধিয়ে তাঁকে হত্যা করার পর ক্রমান্ধয়ে বাংলা দখল করে নেয় মোঘলরা।
    মোগলরা তখন খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।  দাউদ খান কররানী বিদ্রোহী হয়ে বাংলায় স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এভাবে বিভিন্ন উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে চলে বাংলা। দেশ স্বাধীন হবার পর আবার তা চলে যায়। স্বাধীন করে ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় -কে জানি আক্রমণ করে স্বাধীনতা ছিনিয নেয়। এভাবেই বাংলায় চলে নবাবী শাসন। নবাবী আমলে সুখ শান্তিতেই ছিল দেশের মানুষ। কিন্তু ভাগ্যহীন বঙ্গজননীর ললাটে কালিমা লেপন করে। গভীর ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা করে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করে নেয় বেলজ্জ বেনিয়া ইংরেজরা।
    বাংলাদেশসহ গোটা পাকভারত উপমহাদেশ ইংরেজ অধীনে চলে যায়। দীর্ঘ ১৯০ বছর তারা আমাদের শোষণ করে। জুলুম নির্যাতন করে মানুষের হাড়গোড়, অস্থিমজ্জা ভেঙে ভেঙে পঙ্গু করতে থাকে। নিজ দেশে বিদেশী অত্যাচার ও বঞ্চনার ভিতর দিয়ে চলে মানুষ। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা কত না কষ্টের ভিতরে দিনাতিপাত করেছে। তাদের ছিল অন্নহীন, বস্ত্রহীন কংকাল সার দেহ। ছিল না কথা বলার অধিকার। তারা ছিল নিজভূমে পরবাসী। আমাদের গোলা শূন্য হয়ে, পুকুর শুকিয়ে, ছায়াবীথী শ্যামল প্রান্তর পরিনত হয়েছিল বিরান ভূমিতে। জীর্ণ শীর্ণ ছনের ডেরায় অসহায় মানুষ অনাহারে ও অর্ধাহারে জীবন কাটিয়েছেন। অথচ আমাদের সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে তারা ধনী হয়েছে সহস্রগুনে। এ দেশের মানুষের ডেরার পাশে বেনিয়ারা গড়ে তুলেছে সুরম্য লাল লাল দালান কোঠা। জীর্ণ ডেরার পাশে তাদের দালানে লাল রং দিয়ে সাবধান করে দিতো যাতে কেউ সেখানে না যায়। এককালে বাংলায় তৈরি বিখ্যাত মসলিন কাপড় পৃথিবীতে খ্যাত ছিল। সে গৌরবান্বিত মসলিন তৈরি বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের স্বার্থে তারা এ দেশে নীল চাষ করতে বাধ্য করতো। দেশের মানুষের যখন লেংটি জাতীয় কাপড় পরিধানের ব্যবস্থা ছিল না তখন ইংরেজরা আমাদের সামনে কোর্ট, পেন্ট, টাই পরে ঘুরতো। অত্যাচার,নির্যাতন ও শোষণে এভাবে চলার বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ ,ত্যাগী ব্যক্তিরা অনেক সংগ্ৰাম করেছেন। প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবনের বিনিময়ে অবশেষে ১৯৪৭ সালে পাকভারত স্বাধীন হয়েছিল। ইংরেজ তাড়াতে সমর্থ হয়েছিল। এ অবস্থায় ভারত দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তান ও ভারত।
    আমাদের দাবি ছিল স্বতন্ত্র বাংলাদেশ। কিন্তু পাকিস্তানীরা ধর্মের দোহাই দিয়ে নানা অজুহাতে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তান বানায়। শুরুতেই পাকিস্তানের চিন্তা ছিল বাংলাদেশ ধনসম্পদে পূর্ণ । এদেশ থেকে সম্পদ লুট করতে পারলে তাড়াতাড়ি ধনী হওয়া যাবে।
    চিন্তা ছিল কত আগে সম্পদ নিয়ে তারা বড় হবে। আমাদের দাবি নিয়ে আমাদের কথা বলার সুযোগ ছিল না। তারা আমাদের মূল্যায়ন করতো না। চাকরি বাকরি সহ সকল   নাগরিক অধিকার থেকে ছিলাম বঞ্চিত। সকল দিক দিয়ে পিছিয়ে রাখতো। বাঙ্গালির প্রাণের ভাষা বাংলার পরিবর্তে তদস্থলে তারা উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চাইলো। আমাদের সম্পদ ও জনসংখ্যা বেশি থাকা সত্ত্বেও আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তারা গ্ৰাহ্য্ই করতো না। আমাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে যেন তাদের লজ্জা হতো। আমরা যেন তাদের কাছে অস্পৃশ্য । ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়ী হলে ও বাঙালির হাতে তারা ক্ষমতা দেয়নি। বায়ান্ন সালে আমাদের মাতৃভাষার উপর আঘাত করেছিল। তারা বাংলা ভাষা কেড়ে নিতে চাইলে   বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিল। এর ধারাবাহিকতায় বাষট্রির আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান,সত্তরের নির্বাচন, বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা কর্মসূচি এবং আও নানাবিধ আন্দোলন সংগ্রাম করে অনেক রক্ত দিতে হয়েছে। অগনিত বাংলা মায়ের সন্তানের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে।
    এলো একাত্তর। বঙ্গবন্ধুর বজ্র কন্ঠের আহ্বানে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বর্বর হায়েনাদের বিরুদ্ধে বঞ্চিত বাংলার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়লো। শুরু হয় মুক্তির জন্য যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস চলে দারুন এক বিভিষীকাময় যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রাণ দেন, তারা শহীদ হন। আমাদের তিন লক্ষ মা বোনের ইজ্জত নষ্ট করতে হয়।  লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। একাত্তরে ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয় আসে স্বাধীনতা। পাকিস্তনীরা হয় বিতাড়িত।
    এখন বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমরা পেরিয়ে এসেছি পঞ্চম বছর। চলছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণ। ভেবে দেখার সময় এসেছে আমরা কোথায় ছিলাম আর এখন কোথায় আছি। ভাবতে হবে দলমত নির্বিশেষে আমাদের দীর্ঘ দিনের শোষণ বঞ্চনার কথা। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যে স্বাধীনতা এসেছে তাঁর‌ই সুযোগ্য কন্যা পিতার পদাংক করে সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ে তুলছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্ব গুনে ইতিমধ্যেই আমরা পেতে শুরু করেছি অর্থনৈতিক মুক্তি,অর্জিত হচ্ছে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নে উন্নত দেশের দ্বার প্রান্তে।
    সুবর্নজয়ন্তীর দিনগুলোতে আমাদের চিন্তায় আনতে হবে কিভাবে সকল হানাহানি ভুলে সাম্য, শান্তি, শৃঙ্খলা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বলিয়ান হয়ে এগিয়ে যাব। এগিয়ে যাব কাঙ্ক্ষিত চূড়ান্ত লক্ষ্যে। বাংলাদেশকে সোনার বাংলা বিনির্মাণে।
    লেখক: কলামিস্ট, সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও) 

    বাংলাদেশ সময়: ৯:০১ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৬ মার্চ ২০২১

    dainikbanglarnabokantha.com |

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    রূপা

    ২৪ অক্টোবর ২০২০

    নায়িকা হয়েও কবি ছিলেন

    ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

    ছোটগল্প (দেনা)

    ২৫ জুলাই ২০২১

    আর্কাইভ