• শিরোনাম

    রূপগঞ্জে গাজীতে বিমুখ, শাহজাহানে আস্থা

    বাংলার নবকন্ঠ ডেস্ক : শনিবার, ০৬ জানুয়ারি ২০২৪

    apps

    নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে পর পর তিনবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীকে এবার আর চাইছে না রূপগঞ্জবাসী। এই সংসদীয় এলাকার মোট ১১ হাজার ১৭৫ জন ভোটারের ওপর পরিচালিত এক জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, অন্তত ৮৫ শতাংশ ভোটার দস্তগীর গাজীকে আর এমপি হিসেবে দেখতে চান না। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, নিরীহ মানুষের জমি জবরদখল করে নিজের কারখানা স্থাপন, তৃণমূল নেতাকর্মীদের উপেক্ষা করে ক্যাডার বাহিনী দিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করাসহ নানা গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে রূপগঞ্জের মানুষ এখন গাজীর প্রতি বিমুখ। তারা এবার পরিবর্তন চায়; নতুন মুখ দেখতে চায়।

    এই প্রশ্নে ওই জরিপ থেকেই উঠে এসেছে বিকল্প একটি নাম। তিনি হলেন রূপগঞ্জের পর পর তিনবারের উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়া। দীর্ঘদিন ধরে গণমুখী রাজনীতি করা আওয়ামী লীগের এই ত্যাগী নেতা এবার দলীয় মনোনয়ন চেয়েও না পেয়ে জনগণের চাপে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কেটলি প্রতীক নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছেন। জরিপের ফলাফল বলছে, জনসমর্থনের পাল্লা এবার তাঁর দিকেই ঝুঁকে আছে।

    জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৫৪.১৩ শতাংশ ভোটার শাহজাহান ভূঁইয়াকে এলাকার এমপি হিসেবে দেখতে চান; যেখানে গোলাম দস্তগীর গাজীর প্রতি এখনো আস্থার কথা জানিয়েছেন মাত্র ২২.৮২ শতাংশ ভোটার।
    তবে জনসমর্থনের এই হিসাবের প্রতিফলন বাস্তবে খুব সহজেই ঘটতে দেখা যাবে, যদি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়; ভোটাররা বিনা বাধায় পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান; সেটাও জরিপ থেকে উঠে এসেছে। অবশ্য এই প্রশ্নে রূপগঞ্জ আসনে যে আশঙ্কা রয়েই গেছে, সেই বিষয়ে পার্শ্ব-প্রতিবেদনে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

    নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে, নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে মোট ভোটারের সংখ্যা তিন লাখ ৮৫ হাজার ৬২৫।

    এর মধ্যে মুড়াপাড়া, তারাব, ভুলতা, গোলাকান্দাইল, দাউদপুর, রূপগঞ্জ, কায়েতপাড়া ও ভোলাবতে প্রায় ১১ হাজার ১৭৫ জন ভোটার অর্থাৎ ২.৮৯৭ শতাংশ ভোটারের ওপর জরিপ চালানো হয়েছে।
    গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত রূপগঞ্জ উপজেলা ও দুই পৌর এলাকার সাতটি ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের বেশির ভাগ বাড়ির ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছেন জরিপকাজে নিয়োজিত কর্মীরা, যাঁদের বয়সসীমা ছিল ১৮ থেকে ৮৫ বছর পর্যন্ত। জরিপে অংশগ্রহণকারী পুরুষ ভোটারের সংখ্যা সাত হাজার ৫৯৯ ও নারী ভোটারের সংখ্যা তিন হাজার ৫৭৬।

    আমাদের পক্ষ থেকে ১৪টি প্রশ্ন নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন জরিপকর্মীরা। এর মধ্যে ১৮ থেকে থেকে ৩৫ বছর বয়সী চার হাজার ১০২ জন ভোটারের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।

    এ ছাড়া ৩৬ থেকে ৫০ বছর বয়সী তিন হাজার ৮২৭ জন ও ৫০ বছরের বেশি বয়সী তিন হাজার ২৪৬ জন ভোটারের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।
    জানতে চাওয়া হয়েছে, তাঁরা কেন তিনবারের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ মনোনীত এই প্রার্থীর বিকল্প খুঁজছেন। উত্তরে বেশির ভাগ ভোটারই টেনেছেন বিগত ১৫ বছরে রূপগঞ্জে গোলাম দস্তগীর গাজীর দুর্বিষহ দুঃশাসনের প্রসঙ্গ। শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, গৃহিণী থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জরিপে অংশ নেন। এবারের নির্বাচনে রূপগঞ্জে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান গড়ে দিতে পারেন তরুণ ও নতুন ভোটাররা।

    জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৯ হাজার ৫০৬ জন ভোটার এই আসনে নেতৃত্বে পরিবর্তন চান। অর্থাৎ তাঁরা আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী গোলাম দস্তগীর গাজীকে আর চাইছেন না। মাত্র ১২.৬৯ শতাংশ ভোটার মনে করেন, পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। জরিপের তথ্য মতে, ৮৫.০৭ শতাংশ ভোটারই মন্ত্রী গাজীর নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে নাখোশ। বিশেষ করে তাঁর বিরুদ্ধে জমি দখল, মাদক কারবারিদের প্রশ্রয় দেওয়া এবং নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে এলাকায় জনসাধারণের ওপর জুলুম, হামলা, নির্যাতনের কথা বলেছেন ভোটাররা।

    অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তিনবারের উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়ার জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। জরিপে দেখা গেছে, অন্তত ৫৪ শতাংশ ভোটার তৃণমূল ও কর্মীবান্ধব এই নেতাকে সংসদ সদস্য হিসেবে পেতে চান। শাহজাহান ভূঁইয়ার কেটলি প্রতীক নিয়ে তাঁর সঙ্গে রয়েছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা।

    ভোটাররা বলছেন, আসনটিতে নৌকার প্রার্থী গোলাম দস্তগীর গাজী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভূঁইয়ার মধ্যেই মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। তবে তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলামও আলোচনায় রয়েছেন। ৯ জন প্রার্থীর মধ্যে অন্যরা মাঠে নেই বললেই চলে।

    জরিপের তথ্য মতে, ৫৪.১৩ শতাংশ ভোটার শাহজাহান ভূঁইয়াকে জাতীয় সংসদে দেখতে চান। গোলাম দস্তগীর গাজীর পক্ষে মত দেন মাত্র ২২.৮২ শতাংশ ভোটার। এ ছাড়া তৈমূর আলম খন্দকারের পক্ষে ১২.৭৮ এবং সাইফুলের পক্ষে ৩.০২ শতাংশ ভোটার মত দিয়েছেন। বাকিরা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

    ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৩৬.৭০ শতাংশ ভোটার তাঁদের মতামত দেন। ৩৬ থেকে ৫০ বছর বয়সী ভোটারদের মধ্যে ৩৪.২৫ শতাংশ ভোটার জরিপে অংশ নেন। এ ছাড়া ৫১ বছরের ঊর্ধ্বে যাঁদের বয়স, তাঁদের মধ্য থেকে ২৯.০৫ শতাংশ ভোটার জরিপকর্মীদের কাছে তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। মতামত প্রদানকারী ভোটারদের মধ্যে ৬৮ শতাংশ পুরুষ ও ৩২ শতাংশ নারী। ৩১.৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী, ৪৮.৬৬ শতাংশ চাকরিজীবী, ৭.১২ শতাংশ ব্যবসায়ী, ২.৬৬ শতাংশ গৃহিণী এবং অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত ৯.৫৯ শতাংশ ভোটার মতামত প্রদান করেন।

    জরিপের তথ্য আরো বলছে, ১৮ থেকে ৩০ বছরের যুবকরা গোলাম দস্তগীর গাজীর সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন বেশির ভাগই। ১৮ থেকে ৩০ বছরের শ্রমিকরা স্থানীয় এমপি ও তাঁর রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি এবং নিরীহ মানুষের বাড়িতে গিয়ে হামলা, মামলা, বাড়িঘর ও জায়গাজমি দখলের ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে গাজীর পরিবর্তন চান। সম্প্রতি নির্বাচনী প্রচারণায়ও গাজীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদী হয়ে উঠতে দেখা গেছে শ্রমিক শ্রেণিকে।

    এ ছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ৭৬ শতাংশ নেতাকর্মী গোলাম দস্তগীর গাজীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। কারণ তাঁরা তাঁদের দলের কিছু গাজী-অনুগত সন্ত্রাসীর দ্বারা বিভিন্ন সময়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। গত ১৫ বছরে দলীয় কর্মীদের ওপর হামলা, নির্যাতন চালিয়েছে গাজীর ছেলে গাজী গোলাম মূর্তজা পাপ্পা, গাজীর এপিএস এমদাদসহ তাঁর ক্যাডার বাহিনী। অনেক সৎ, দক্ষ ও ত্যাগী নেতাকর্মীকে পদ-পদবি থেকে সরিয়ে দিয়ে হাইব্রিডরা দলে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁরা এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চান দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।

    অন্যদিকে তিনবারের উপজেলা চেয়ারম্যান ও রূপগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান ভূঁইয়া এলাকার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তাঁর বিষয়ে প্রশংসা উঠে আসে সাধারণ ভোটারদের মধ্য থেকে। তাঁদের ভাষ্য, গোলাম দস্তগীর গাজীর মতো অত্যাচারী জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে যে ব্যক্তিই অবস্থান নেবেন, তাঁর পক্ষে থাকবেন সাধারণ ভোটাররা। এ ছাড়া পর পর তিনবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে শাহজাহান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে তেমন কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নেই।

    রূপগঞ্জের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দা ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বচানের ভোটার শাহজাহান ইসলাম সবুর বলেন, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে কয়েক দিন পর পরই এই এলাকায় হামলা-খুনের মতো ঘটনা ঘটছে। বর্তমান সংসদ সদস্যের পক্ষ থেকে মাদক ব্যবসা বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং এই সন্ত্রাসীরা মন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তুলে তাদের ক্ষমতার জানান দেয়।

    তিনি বলেন, ‘এবারের ভোট নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও যদি সুষুম ভোট হয়, আমি আমার মতামত জানাব। যোগ্যতার ভিত্তিতে শীর্ষে থাকা প্রার্থীকে নির্বাচিত করব।’

    আতলাপুরের বাসিন্দা ৭৪ বছর বয়সী জয়নাল মোল্লা বলেন, ‘ভোট দেওয়ার সুযোগ পাইলে ভোট দিব। এখন কথা বলে লাভ নাই।’

    রূপগঞ্জের বড়ালু পাড়াগাঁওয়ের চায়ের দোকানে কথা হয় হাসিবুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, রূপগঞ্জের আওয়ামী লীগ দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে গত ১৫ বছরে সুবিধাভোগীরা বর্তমান সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীর পক্ষে থাকলেও সুবিধাবঞ্চিত প্রায় ৭৫ শতাংশ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কর্মী শাহজাহান ভূঁইয়ার পক্ষে কাজ করছেন।

    তিনি বলেন, ‘শেষ হাসিটা শাহজাহান ভূঁইয়াই হাসবেন। কারণ তাঁর নামে কোনো কালি নাই। আওয়ামী লীগকে ভালোবেসে রাজনীতি করেছেন। কারো ক্ষতি করেন নাই। জমি দখল করেন নাই। মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও তাঁর আঁতাত নাই।

    বাংলাদেশ সময়: ১১:৫২ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০৬ জানুয়ারি ২০২৪

    dainikbanglarnabokantha.com |

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    আর্কাইভ