নূরুদ্দীন দরজী:
মানুষের জীবন কেবলই সময়ের যোগফল। সমস্ত যোগের একদিন হয়ে যায় বিয়োগ। দিন, ক্ষণ, মাস ও বছর হতে হতে কখন যে সময় ফুরিয়ে যায় মানুষ ঠাওর করতে পারে না। আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগের কথা। ১৯৭৫-৭৬ শিক্ষাবর্ষে শিবপুর শহীদ আসাদ কলেজ হতে বিএ পরীক্ষা দিয়েছিলাম। একই কলেজ হাত এইচ এস সি ও পাশ করেছি। কোলাহল পূর্ণ কলেজ জীবন আমার ছিলনা। ভর্তি হয়েছিলাম নৈশ বিভাগে। নৈশ বিভাগের ক্লাস তেমন নিয়মিত ছিলনা। বাড়িতে বসেই পড়তে হতো। কারণ,আমি এসএস সি পাশ করেই প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে চাকরি নামক সোনার হরিণটি ধরেছিলাম। সংসারে উপার্জন করার মত কেউ ছিল না বলেই আমার এ দশা। ১৯৭৬ সাল। পবিত্র রমযান মাসে স্কুল বন্ধ ছিল। কেন জানি কলেজ ছিল খোলা। ২০ রমজান পর্যন্ত সে বছর কলেজে ক্লাস হয়েছিল। স্কুল বন্ধ আর কলেজ খোলা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য একদিন কলেজে দিবা শাখার ক্লাসে ঢুকে পড়ি। হঠাৎ আমাকে দেখে ছাত্র শিক্ষক সবাই আশ্চর্য হয়ে যায়। কোথা থেকে হঠাৎ এলাম। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল শ্রদ্ধেয় নূরুল ইসলাম খান স্যার আমাকে দেখে অনেক খুশি হয়েছিলেন। একই গ্ৰামে আমাদের বাড়ি। আগে থেকেই তিনি চিনতেন ও স্নেহ করতেন। কলেজ অফিসে বসে ঐ দিন তিনি আমাকে নিয়ে অন্যান্য স্যারের সাথে কথা বলেছেন হঠাৎ আমার আগমন নিয়ে। কথা বলেছিলেন আসন্ন বিএ পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে। এখানে একটু উল্লেখ করছি যে, তখনকার সময় বিএ পাশের হার ছিল নিতান্তই কম। শতকরা পাঁচ সাতের বেশ নয়। প্রতি বছর পত্রিকায় ফলাফল বের হওয়ার সাথে সাথে পাশের হার শূন্য এমন কলেজের নামগুলো যেন গুরুত্বের সাথে জানিয়ে দেওয়া হতো । অবস্থা এমন ছিল যে,কোন কোন কলেজ থেকে কয়েক বছর ধরে কেউ পাশ করতো না। আমার সরাসরি বিএ ক্লাসের প্রথম দিন যথারীতি ক্লাসগুলো একের পর এক চলছিল। দুতিনটি ক্লাস হওয়ার পর ক্লাসে এলেন খলিল স্যার। ঢুকেই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে লেকচার দিয়ে যাচ্ছেন। ছাত্র-ছাত্রীরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল। হঠাৎ স্যারের শুভ দৃষ্টি পড়লো আমার উপর। মনে হয় কিছুটা জেনে ও না জানার মত আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-তুমি কে-হে? তোমাকেতো চিনতে পারলাম না। অনেকটা অপ্রস্তুত অবস্থায় বললাম,স্যার, আমি নূরুদ্দীন আহাম্মেদ। প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করি। এবার বিএ পরীক্ষা দিব। স্কুল বন্ধ থাকায় কয়েক দিন ক্লাস করবো। স্যার মুচকি হাসির দৃষ্টি নিয়ে আমার কথাগুলো শুনেন। এক পর্যায়ে বলেন,-তুমিতো কোন দিনই ক্লাসে আসেনি। পাশ করবে কি ভাবে? হাতিঘোড়া গেল তল -বেঙ ভাইয়া বলে কত জল? বলে বলে হাসছেন এবং সাথে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা। তখন ক্লাসের অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রী গণ অনেকটা টিপ্পুনী দিয়ে কেউ কেউ বলাবলি করছিল। সর্বশেষ স্যার বললেন, দেখ চেষ্টা করে কিছু করতে পারে কিনা। উপদেশ সুরে বললেন, তোমার কোন সহযোগিতা প্রয়োজন হলে বোডিং এ এসে আমার সাথে দেখা করো।স্যারের হাস্য রসাত্মক করুন রসে পূর্ণ গাম্ভীর্যতায় ভরা কথায় আমি হত চকিত হয়ে আশা ও নিরাশা সাগরে নিমজ্জিত না উত্থিত বুঝতে পারছিলাম না। তবে খানিক আশার আলোই বোধ হয় দেখতে পাচ্ছিলাম। খলিল স্যারের সেদিনের সাবলীল ছন্দময় তাৎপর্যপূর্ণ নান্দনিক ভর্ৎসনা ও অপূর্ব গুরদক্ষিনা আজ ও আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীর অমীয় বাণীরুপে অন্তরের সুগভীরে গ্ৰথ্বিত রয়েছে। এখনো শুনতে পাচ্ছি প্রিয় স্যারের ‘চেষ্টা করে দেখো, কথাটি,। সময়ের ব্যবধানে যথসময়ে আমাদের বিএ পাশের জন্য পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। কেন্দ্র ছিল নরসিংদী কলেজে। সম্ভবত প্রথম দিনই ইংরেজি পরীক্ষা। নকলের ভেজালে পড়ে সেদিন অধিক সংখ্যক ছাত্রছাত্রী Expelled হচ্ছিল। দায়িত্ব প্রাপ্ত ম্যাজিষ্ট্যাট রোমে ঢুকে ঢুকেই -You are Expelled! you are Expelled!! and you are Expelled বলার তান্ডবে কক্ষগুলো অর্ধেক হারে খালি হয়ে পড়েছিল। অনেক পরিচিত বন্ধুরা Expelled হয়ে কেঁদে কেঁদে বাড়ি ফিরেছিল যাদের অনেককেই এখনো যেন দেখতে পাচ্ছি। ফলাফল বের হতে অনেক বিলম্ব হচ্ছিল। এর মধ্যে নানারকম কথাবার্তা। অধিক হারে ফেল করানোর চেষ্টা হচ্ছে, ইংরেজি উত্তর পত্র বার বার দেখা হচ্ছে এবং শুধুই নাকি ফেল করানোর প্রচেষ্টা চলছে ইত্যাদি, ইত্যাদি। অবশেষে একদিন হঠাৎ কাঙ্ক্ষিত ফল প্রকাশিত হলো। প্রিন্সিপাল স্যার ঢাকা থেকে অনেক রাতে ফলাফল শীট নিয়ে শিবপুর পৌঁছেছিলেন শুনেছি। সেদিন রাতে আমি বাড়ির পাশের বিলে আনন্দে বন্ধুদের সাথে মাছ ধরতে গিয়েছি। প্রিন্সিপাল স্যার রাতেই পাশের খবরটি বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন।ডুলা ভর্তি অনেক কৈ মাছ পেয়েছি সেদিন। পরের দিন সকালে বাড়ি এসেই সুখবরটি পেয়ে কত যে আনন্দ পেয়েছি সে কথা এখন বোধ হয় বুঝানো সম্ভব নয়। কিছু ক্ষণের মধ্যে কলেজে খলিল স্যারের রোমে দেখা করে স্বগৌরবে বলি -স্যার, আমি পাশ করেছি। স্যার চোখ বড় বড় করে বলেন -তাই নাকি? আমারতো বিশ্বাস হচ্ছেনা। তোমাদের গ্ৰামের মেজু দশ বছর যাবত চেষ্টা করে যা পারলো না তুমি তা করে ফেলেছো? স্যারের স্বভাবসুলভ মজার মজার কথা বলা শেষ হলে তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে এবং পিঠে চাপ দিয়ে যেভাবে আদর করেছিলেন সে কথা মনে হলে আজ ও শিউরে উঠি। সেদিনের সে ক্ষণে আবার চলে যেতে প্রবল বাসনা জাগে। সে বছর আমরা তিনজন পাশ করেছি এ কলেজ থেকে। অন্য একজন নজরুল ইসলাম পরে এ কলেজের লাইব্রেরীয়ান ও অপরজন হাজেরা খাতুন পরে দত্তের গাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক হয়েছিলো। ততটুকু জানি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অগ্নিস্ফূলিঙ শহীদ আসাদের স্মৃতি বিজড়িত কলেজে এসেছিলেন মান্নান ভুঁইয়ার বন্ধুত্বের পথ ধরে। বলতে গেলে অনেকটাই বিনা বেতনে কাজ করেছেন দীর্ঘ দিন। ছিলেন ভাইস প্রিন্সিপাল হয়ে। সমসাময়িক অন্যান্য শ্রদ্ধেয় প্রফেসর মহোদয়গন জনাব আলী করিম,জনাব মনিরুজ্জামান, জনাব মোতালেব হোসেন, ফারুকী ও পরে ইংরেজিতে বেলায়েত স্যারসহ অনেকে। সবাই ছিলেন শ্রদ্ধাভাজন যাদের মধ্যে খলিল স্যার স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী । তিনি ছিলেন কলেজের কেন্দ্র বিন্দুতে। কলেজ ক্যাম্পাসে স্যারের যে কোন মুহুর্তে আগমনে সবাই হতো উৎফুল্ল, বিনীত নিরবতায় শান্তির পরশ এবং যে কোন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে এক সময় তিনি চলে গেলেন। চলে গেলেন আরও বৃহত্তর পরিসরে। পরবর্তিতে স্যার হয়েছিলেন উচ্চ শিক্ষা বিভাগের পরিচালক, হয়েছেন ডাইরেক্ট্র জেনারেল (ডিজি)। সর্বশেষ নায়েমের ডাইরেক্টর জেনারেল। কলেজ শিক্ষকের মহান পেশায় খলিল স্যারের কর্মনিষ্ঠতা, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও জীবন ঘনিষ্ঠ শিক্ষা দান ব্রতের জন্য শহীদ আসাদ কলেজ সহ এতদ্বাঞ্চলের সকল মানুষের কাছে তিনি হয়ে রয়েছেন বিশ্ময়কর জীবন্ত ছবি। এ পরশ পাথরের ছোঁয়ায় অনেকেই পেয়েছে সাফল্যময় জীবন। শিবপুর কলেজে তাঁর গৌরব গাঁথা ও সাফল্য সবার মনে প্রায় অর্ধ শতাব্দী ব্যাপী ধ্বনিত ও স্মরিত যা শিবপুরের মানুষ আরও স্মরন রাখবে বহুদিন। বনভান্তে বলেছেন,-হাসি নহে ,খুশি নহে ,নহে রসিকতা,-হাসি খুশিতে জ্ঞান দান আর শিক্ষকতা। এমন কথার স্বার্থকতা প্রিয় খলিল স্যারের মধ্যে শতভাগ পাওয়া যায়। বিশাল ও সফল কর্মযজ্ঞের অবসানে এখন স্যার অবসরে। অখন্ড অবসর। হয়তো একদিন আসবে সকরুণ কৃঞ্চসন্ধ্যা ।চর্মচোখে দেখা না হলেও তিনি থাকবেন তাঁর স্নেহের ছাত্র-ছাত্রীদের দীব্যচোখে। তিনি বেঁচে থাকবেন আপন সৃষ্টি মাঝে। প্রাশ্চাত্য মনীষী হেনরী এ্য।ডামস বলেছেন, শিক্ষকের প্রভাব অনন্তকাল ও শেষ হয়না। ঠিক তেমনি শ্রদ্ধেয় খলিল স্যারের প্রভাব অবশ্যই শেষ হবার নয়। তিনি থাকবেন স্বীয় সৃষ্টি মাঝে। অতীত অতীত হলেও খলিল স্যারেরা সর্বকালেই বর্তমান।
লেখক: কলামিস্ট ও সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও)