রবিবার ১৬ মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২ চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

>>

মাটির সুস্বাস্থ্য ও কৃষিকে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট

রাহিমা আক্তার রিতা ঃ   |   মঙ্গলবার, ১২ মার্চ ২০২৪   |   প্রিন্ট

মাটির সুস্বাস্থ্য ও কৃষিকে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট

মাটি বা মৃত্তিকা হলো পৃথিবীর উপরিভাগের নরম আবরণ। পাথর গুঁড়ো হয়ে সৃষ্ট খনিজ পদার্থ এবং জৈব যৌগ মিশ্রিত হয়ে মাটি গঠিত হয়। জৈব পদার্থের উপস্থিতিতে ভূমিক্ষয় আবহবিকার, বিচূর্ণিভবন ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে পাথর থেকে মাটির উদ্ভব হয়েছে। সে কারণে অতি প্রাচীন কালের মাটি পৃথিবীতে পাওয়া যায় না। উদ্ভিদ জন্মানোর উপযোগী খনিজ, জীব ও জৈব সমন্বয়ে গতিশীল প্রাকৃতিক বস্তুকে মাটি বা মৃত্তিকা বলে। মাটি হচ্ছে কঠিন পদার্থের ছোট ছোট টুকরা, পানি ও বায়ুর সমন্বয়ে গঠিত যৌগিক পদার্থ। উদ্ভিদ জন্মানোর উপযোগী খনিজ, জীব ও জৈব সমন্বয়ে গতিশীল প্রাকৃতিক বস্তুকে মাটি বা মৃত্তিকা বলে। পৃথিবীর উপরিভাগের যে নরম স্তরে গাছপালা মূল স্থাপন করে রস শোষণ করে জন্মায় ও বৃদ্ধি পায় তাকে মাটি বলে। মাটি বা মৃত্তিকা হলো পৃথিবীর উপরিভাগের নরম ও দানাদার আবরণ। পাথর গুঁড়ো হয়ে সৃষ্ট খনিজ পদার্থ এবং জৈব যৌগ মিশ্রিত হয়ে মাটি গঠিত হয়। মাটি বিশ্বের সবচেয়ে বিস্ময়কর জাদুকরি বস্তু।

মাটি প্রধান উপাদান
১. খনিজ পদার্থ- ৪৫%
২. জৈব পদার্থ- ৫%
৩. বায়ু- ২৫%
৪. পানি- ২৫%।

মাটির মধ্যে এই জৈব পদার্থের পরিমাণ ৫% হলেও এটিকে মাটির লাইভ বা জীবন বলে। যে মাটিতে জৈব পদার্থ থাকে না তাকে ডেড সয়েল বা মৃত মাটি বলে। অর্থাৎ মৃত মাটিতে কোনোভাবেই ফসল ফলানো সম্ভব নয়। এজন্য মরুভূমিকে ডেড সয়েল বলা হয়। অর্থাৎ মরুভূমির মাটিতে জৈব পদার্থ না থাকায় ওই মাটিতে কোনো প্রকার উদ্ভিদ বা ফসল জন্মায় না। মানুষ সৃষ্টির আগে মহান সৃষ্টিকর্তা মাটিকে সৃষ্টি করেছিলেন ১০৫টি উপাদানের সমন্বয়ে। তার ভেতর ১৬টি উপাদানকে উদ্ভিদের মূল খাদ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন মৃত্তিকা গবেষকরা। মাটির মূল ১৬টি উপাদানের মধ্যে অক্সিজেন, কার্বন ও হাইড্রোজেন পেয়ে থাকে বাতাস এবং পানির মাধ্যমে। গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নাইট্রোজেন সিংহভাগ প্রাকৃতিকভাবে পেয়ে থাকে মেঘ চমকানো বিদ্যুৎ ও কুয়াশা থেকে। অন্য উপাদানগুলোও মাটি প্রাকৃতিকভাবে পেলেও তার খাদ্য চাহিদার তুলনায় কম। মাটির অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদান যেমন- নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান মাটিতে যুক্ত থাকে।

মাটির প্রকারভেদ
১. এঁটেল মাটি
২. বেলে মাটি
৩. দোআঁশ মাটি।

মাটির বৈশিষ্ট্য
এঁটেল মাটি: এঁটেল মাটিতে বালু অপেক্ষা পলি ও কাদার ভাগ বেশি থাকে। এ কাদা মাটি খুব নরম, দানা খুব ছোট ও মিহি। এ মাটি বেশি পানি ধরে রাখতে পারে। এ মাটিতে ভালোভাবে বাতাস চলাচল করতে পারে না। এ মাটি সব ফসলের জন্য তেমন উপকারী নয়, তবে ধান চাষ করা যায়।
বেলে মাটি: বেলে মাটিতে বালির ভাগ বেশি থাকে। এ মাটির পানি ধারণক্ষমতা কম। বেলে মাটিতে ফসল তেমন ভালো হয় না। তবে তরমুজ, শসা, বাঙ্গি, চিনাবাদাম, মিষ্টি আলু ইত্যাদি ভালো জন্মে।
দোআঁশ মাটি: দোআঁশ মাটিতে বালি, পলি ও কাদা সমপরিমাণে থাকে। এ মাটির পানি ধারণক্ষমতা মাঝারি। চাষাবাদের জন্য দোআঁশ মাটি উপযুক্ত। এ মাটিতে ধান, পাট, গম, পিঁয়াজ, মরিচ, ভুট্টা, আলু, শাক-সবজি ইত্যাদি ভালো জন্মে।
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর উদযাপন করা হয়। ২০০২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সয়েল সায়েন্স কর্তৃক মাটি নিয়ে প্রতি বছর একটি উৎসব বা অনুষ্ঠান করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক দিবস নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়। থাইল্যান্ডের রাজার নেতৃত্বে এবং গ্লোবাল সয়েল পার্টনারশিপের কাঠামোর মধ্যে, এফএও বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের আনুষ্ঠানিক যাত্রা বা সূচনাকে সমর্থন করে। ২০১৩ সালের জুনে এফএও সম্মেলনে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের দিনটি ঠিক হয় এবং পরে ৬৮তম জাতিসংঘ জাতীয় সাধারণ পরিষদের কাছে দিনটি পাঠানো হয়। যাতে জাতিসংঘ ৫ ডিসেম্বরকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত্তিকা দিবস হিসেবে গ্রহণ করে।
বাংলাদেশের মাটি ও কৃষি
বাংলাদেশে চালানো এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষি জমির জৈব উপাদান কমে গেছে। ফলে ফসল উৎপাদনে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হচ্ছে। এ গবেষণায় বলা হয়েছে, ফসলি জমিতে যেখানে ৫ শতাংশ জৈব উপাদান থাকা দরকার; সেখানে দেশের বেশিরভাগ কৃষি জমিতে জৈব উপাদান দুই শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৫৬ শতাংশ জমিতে ফসলের আবাদ হয়। দেশটির আবাদি জমি, বনভূমি, নদী, লেক, বনাঞ্চল মিলিয়ে মোট জমির পরিমাণ ১ কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ জমিতেই জৈব উপাদানের ঘাটতি রয়েছে। কৃষি জমির অবক্ষয় নিয়ে ২০০০ সালে একটি গবেষণা করা হয়েছিল। এরপর চলতি বছর একই ধরনের আরেকটি গবেষণা চালালে দেখা যায় যে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন অধিদপ্তরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বলেন, ‘সাধারণত মাটিতে ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের মতো দেশে যেখানে উষ্ণ আবহাওয়ার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া এবং তাপমাত্রার ঘন ঘন পরিবর্তন বিভিন্ন বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনিত কারণে জৈব পদার্থ বেশি বিয়োজন হয়। তাই আমাদের মাটিতে সাড়ে ৩ পার্সেন্ট জৈব পদার্থ থাকলেও হয়।’ আমরা দেখেছি যে, জমিতে এই পরিমাণ ২ শতাংশের নিচে এমনকি কোথাও কোথাও ১ শতাংশের নিচে রয়েছে। মাটির জৈব উপাদানকে মাটির প্রাণ বলে অভিহিত করেন কৃষিবিদ এবং বিজ্ঞানীরা।
মাটির উন্নয়নে বর্জনীয়
কৃষিকাজে শুধু একক মাটিকে ব্যবহার না করা। অতিরিক্ত এবং অনুপযুক্ত চাষাবাদ পরিহার করা। অতিরিক্ত সেচ পরিহার করা। জমিতে অতিমাত্রায় গোচারণ বন্ধ করা। প্রচলিত এক ফসলি চাষাবাদ বন্ধ করা। সারের অপব্যবহার বন্ধ করাসহ অপব্যবহার এবং কম ব্যবহার করা।
মাটি উন্নয়নে করণীয়
শস্যের বৈচিত্র্য মিশ্রণ, আন্তঃফসল, ফসলের আবর্তন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা। সারের ব্যবহারে যথাযথভাবে নিয়ম মেনে চলা। টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা মেনে চলা। টেকসই চারণ এবং চারণভূমি ব্যবস্থাপনা করা। জৈব সার, মালচিং, উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশ, সবুজ সার যুক্ত করা। হ্রাসকৃত ভূমিকর্ষণ পদ্ধতি অবলম্বন করা।
কৃষিকে আরও ত্বরান্বিত করতে হলে মৃত্তিকা সম্পদ ও সম্প্রসারণে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গবেষণার মাধ্যমে সার সুপারিশমালার ভিত্তিতে আবাদ করতে হবে। তাহলে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার হ্রাস পাবে। মাটিও থাকবে নিরাপদ। উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার মূলে কাজ করছে কৃষির ব্যাপক সাফল্য। আর এ সাফল্যকে ধরে রাখতে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের কৃষি ও মাটির দিকে আরও অধিকতর মনোযোগ দেওয়া অতীব জরুরি।
এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে, কৃষির অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখতে হবে। দেশের ১৭ কোটি মানুষকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করছে কৃষি। তাই কৃষির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হলে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরই প্রভাব ফেলবে। তাই আগামী দিনে কৃষি ও কৃষকের সার্বিক কল্যাণে শুধু রাসায়নিক সারই নয়, মাটির প্রাণ জৈব সারে প্রয়োজনীয় ভর্তুকির ব্যবস্থা করে দেশের কৃষিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে সংশ্লিষ্ট মহল। এই প্রত্যাশায় আগামীতে তৈরি হবে টেকসই, পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তায় সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশের, স্মার্ট কৃষি। মাটির সুস্বাস্থ্য নিয়ে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট এর মহাপরিচালক মোঃ জালাল উদ্দিন বলেন মাটির সুস্বাস্থ্য রক্ষায় আধুনিক উন্নত স্মার্ট কৃষি ক্ষে‍ত্র তৈরি করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।

Facebook Comments Box

Posted ২:০৪ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১২ মার্চ ২০২৪

dainikbanglarnabokantha.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আজ বিজয়া দশমী
(1026 বার পঠিত)

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক

রুমাজ্জল হোসেন রুবেল

বাণিজ্যিক কার্যালয় :

১৪, পুরানা পল্টন, দারুস সালাম আর্কেড, ১১ম তলা, রুম নং-১১-এ, ঢাকা-১০০০।

ফোন: ০১৭১২৮৪৫১৭৬, ০১৬১২-৮৪৫১৮৬, ০২ ৪১০৫০৫৯৮

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

design and development by : webnewsdesign.com

nilüfer escort coin master free spins