শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

>>

বাগেরহাটের স্বাস্থ্য সেবা গ্রামে চিকিৎসক নেই, শহরে রোগীর চাপে হিমশিম

মনিরুল হক, স্টাফ রিপোর্টারঃ   |   বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩   |   প্রিন্ট

বাগেরহাটের স্বাস্থ্য সেবা গ্রামে চিকিৎসক নেই, শহরে রোগীর চাপে হিমশিম

গায়ে জ্বর নিয়ে ২২ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পৌনে ১ ঘণ্টায় বাগেরহাট জেলা হাসপাতালে আসেন কচুয়া উপজেলার সোনাকান্দি গ্রামের গৃহিণী মিম আক্তার। এরপর বহির্বিভাগের টিকিট নিয়ে চিকিৎসকের দেখা পেতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে আরও প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা। হাসপাতলের বারান্দায় কথা বলার একপর্যায় কেঁদে ফেলেন মিম। বলেন, ‘এই জ্বরে আমার ১১ দিনের ছেলেটা মইরে গেইছে দুই মাস আগে। বাড়ির কাছে ডাক্তার না থাকায় প্রথমে গ্রামের লোকের কথায় ওষোধ খায়াইছি। তারপরও ভালো না হওয়ায় এই হাসপাতালে আইছিলাম। কিন্তু এরা খুলনায় পাঠাই দিছে। একদিন পর ছেলে আমার মইরেই গেল।’ জ্বর–সর্দির মতো সাধারণ রোগের চিকিৎসা বাড়ির কাছেই বিনা মূল্যে পাওয়ার কথা। কিন্তু মিম আক্তার বা তাঁর নবজাতক কেন সেই সেবা থেকে বঞ্চিত হলেন? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মিমের বাড়ি সোনাকান্দি গ্রামে গিয়ে জানা যায়, প্রান্তিক মানুষের সরকারি চিকিৎসাসেবায় হাহাকারের কথা। মিম বলেন, ‘বাড়ির কাছে ইউনিয়ন (গজালিয়া) হাসপাতাল আছে, ক্লিনিক আছে। কিন্তু সেহেনে কোনো ডাক্তার থাহে না। ডাক্তার থাকলি তো আমাগো এতো দূরি দোড়োতি হতো না। আমার ছেলেডাও হয়তো মরতো না।’ মিমের মতো ওই দিন হাসপাতালের নিচতলার একটি কক্ষের সামনে জ্বর নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়ন থেকে আসা মো. ওলিয়র (৪৪)। তাঁর ইউনিয়নেই দুটি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র আছে। বাড়ির কাছের সেই কেন্দ্রে না গিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওখানে কোনো ডাক্তার থাকে না। গিয়ে কী হবে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) আদর্শ মান অনুযায়ী, প্রতি এক হাজার জনসংখ্যার জন্য একজন চিকিৎসক থাকা দরকার। ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, বাগেরহাটের জনসংখ্যা ১৬ লাখ ১৩ হাজার ৭৬। সেই হিসাবে জেলায় চিকিৎসক থাকা দরকার ১ হাজার ৬১৩ জন। কিন্তু আছেন মোটে ১৭১ জন। তাঁরা সেবা দেন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে। ইউনিয়ন পর্যায়ে তাঁদের দেখা পান না প্রান্তিক মানুষেরা। ফলে তাঁদের দৌড়াতে হয় জেলা বা উপজেলা সদরে। সেখানে আবার রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসকদের। বাগেরহাটের ৯ উপজেলায় মোট ইউনিয়ন ৭৫টি। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৮ ইউনিয়নে স্বাস্থ্য বিভাগের ৮টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং ৬১ ইউনিয়নে পরিবার কল্যান বিভাগের ৬৩টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র আছে। এসব কেন্দ্রে থাকার কথা একজন করে এমবিবিএস চিকিৎসক। সপ্তাহে ৬ দিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত সাধারণ চিকিৎসা সেবা এবং ৭ দিন ২৪ ঘণ্টাই নিরাপদ প্রসব ও জরুরি প্রসূতি সেবা মেলার কথা। ৭টি ইউনিয়নে এ ধরনের কোনো সেবা কেন্দ্র নেই। জনবল কাঠামো অনুযায়ী, উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিটিতে একজন করে চিকিৎসা কর্মকর্তা, উপ-সহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা (এসএসিএমও), ফার্মাসিস্ট, এমএলএসএস/অফিস সহায়ক ও মিডওয়াইফ (নার্স) থাকার কথা।

এই ৫টি পদ ছাড়াও কেন্দ্রগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের এফডব্লিউভি (পরিবার কল্যান পরিদর্শিকা) ও আয়ার দুটি পদ রয়েছে। কেন্দ্রে আছে দুজনের আবাসন ব্যবস্থাও। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ পরিচালিত ৬৩টি ‘ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে’র প্রতিটিতে একজন করে এসএসিএমও, ফার্মাসিস্ট, এফডব্লিউভি, অফিস সহায়ক কাম নিরাপত্তা প্রহরী ও আয়া পদ ছাড়াও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের একজন করে সহকারী সার্জন/ চিকিৎসা কর্মকর্তা (এমবিবিএস) ও এসএসিএমও পদ আছে। আছে দুজনের আবাসন ব্যবস্থা। জেলায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে সব মিলিয়ে চিকিৎসক পদ আছে ৩১০টি। কিন্তু কর্মরত আছেন ১৪২ জন। এর মধ্যে আবার ১১ জন প্রেষণে আছেন জেলার বাইরে। এর সঙ্গে পরিবার কল্যাণ বিভাগে আছেন ৮ জন চিকিৎসক। এই মোট ১৩৯ জন সরকারি চিকিৎসকের পাশাপাশি জেলায় আরও ৩২ জন বেসরকারি চিকিৎসক আছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) বাগেরহাট শাখার সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) আদর্শ মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতি ১ হাজার মানুষের জন্য একজন চিকিৎসকের বদলে এখানে ৯ হাজার ৪৩৩ জন মানুষের বিপরীতে চিকিৎসক আছেন একজন। সরকারি স্বাস্থ্যসেবার বেলায় এই অনুপাত ১: ১১,৬০৫। জেলা হাসপাতাল ও ৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মিলে নার্সের পদ ৪০৪। কর্মরত আছেন ৩৫৭ জন। যদিও ডব্লিউএইচওর গাইডলাইন অনুযায়ী থাকার কথা ৪ হাজার ৮৩৯ জন। টেকনিশিয়ানসহ অন্যান্য জনবলের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। গত তিন মাস ধরে বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলার ২১টি ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ঘুরে কোথাও চিকিৎসা কর্মকর্তার দেখা পাওয়া যায়নি। তাঁদের বসার মতো ব্যবস্থাও নেই কেন্দ্রগুলোতে। অধিকাংশ জায়গায় রোগী দেখেন এসএসিএমও, এফডব্লিউভি ও ফার্মাসিস্ট। স্বাস্থ্যের দুই বিভাগ মিলে ৭টি পদের মধ্যে অধিকাংশ কেন্দ্রে ২ থেকে ৩টি পদে জনবল থাকলেও বাকিগুলো শূন্য। কোনো কোনো কেন্দ্রে জনবল দেখা গেছে একজন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী, এসব কেন্দ্রে ২৪ ঘণ্টা মাতৃত্বকালীন প্রসুতি সেবার পাশাপাশি সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, কৈশরকালীন সেবা, পুষ্টি ও স্কুল হেলথ কার্যক্রম চলার কথা। তেলিগাতী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোরশেদা আক্তার বললেন, ‘আমার এলাকা থেকে উপজেলা ও জেলা হাসপাতাল বেশ দূরে। এখানে দুটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকলেও কোনো ডাক্তার নেই। পরিবার পরিকল্পনার লোকজন কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছেন।’ চিকিৎসক না বসায় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয়দের আগ্রহ কম বলে জানালেন ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হিটলার গোলদার। উপজেলা ও জেলা হাসপাতাল থেকে বেশ দূরে কচুয়া উপজেলার বাঁধাল মডেল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান কেন্দ্র। জেলার যে ৫টি কেন্দ্রে ফার্মাসিস্ট নিয়োগ আছে, তার একটি এটি। অবকাঠামো ঠিক থাকলেও চিকিৎসক না থাকার অসন্তোষ আছে স্থানীয়দের। এলাকার গৃহিণী বিথিকা রানী বলেন, ‘এখানে একজন ডাক্তার (এসএসিএমও) আছে, তবে বড় ডাক্তার (এমবিবিএস) বসে না।

একজন বড় ডাক্তার হলি আমাগো অনেক ভালো হতো। ডাক্তার দেহাতি হলি আমাগো এহেন দে পিরিসপুর (পাশের পিরোজপুর জেলা) যাতি হয়।’ সরেজমিনে দেখা যায়, বাগেরহাট সদরের বেমরতা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণের কেন্দ্রের ভবনটি পরিত্যক্ত। মূল ভবনের পাশের কোয়াটারটিকে মেরামত করে কোনো রকমে চলছে ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে। তবে এফডব্লিউভি না থাকায় এবং নারী এসএসিএমও না থাকায় প্রসব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এই কেন্দ্রের নৈশপ্রহরী ফারুক ইজারাদার বলেন, ‘আমার ২০ বছরের চাকরি জীবনে মোরেলগঞ্জের বনগ্রামে ১৯৯৬ সালের দিকে একবার ডাক্তার (এমও) পাইছি। এরপর আর কোনোদিন আমাদের কেন্দ্রে ডাক্তার পাইনি। শুনছি, আগে পরিবার পরিকল্পনারই ডাক্তার ছিল, কিন্তু এই পদে প্রায় ৩০ বছর ধরে নিয়োগ নাই।’ মূল ভবন পরিত্যাক্ত হওয়াতে কোয়াটারে সেবা চালাতে হচ্ছে কাড়াপাড়াতেও। ২৫০ শয্যা হাসপাতালের (আরএমও) আদনান রুমেল বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসক, নার্সসহ জনবল সংকট তীব্র, কিন্তু রোগীর চাপ অনেক বেশি। বহিরবিভাগে প্রতিদিন ৭-৮ জন চিকিৎসককে হাজার থেকে ১২ শ মানুষকে সেবা দিতে হয়। কোনো কোনোদিন একজন চিকিৎসককে দেড় শ’রও বেশি রোগী দেখতে হয়। মানসম্মত সেবা দিতে গেলে এই ভয়াবহ চাপ কমাতে হবে।’ অনুসন্ধানে দেখা যায়, বহির্বিভাগে রোগী দেখার সময়সূচি সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত হলেও রোগী দেখার জন্য সময় থাকে ৪ ঘণ্টা। প্রতিদিন গড়ে ১১শ রোগী ও ৮ জন চিকিৎসক থাকলে একজন রোগীর ভাগে ২ মিনিটও জোটে না। সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বাগেরহাটের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক চৌধুরী আবদুর রব বলেন, একজন চিকিৎস নিয়মিত না হলেও সপ্তাহে অন্তত দুদিন যদি ইউনিয়ন পর্যায়ে সেবা দিতেন তবে ওই এলাকার সেবার চিত্র পাল্টে যেত। সাধারণ মানুষকে কষ্ট করে দূরের হাসপাতালে গিয়ে সময় আর টাকা নষ্ট করতে হত না। সেই সঙ্গে ভুল বা অপচিকিৎসার শিকারও হতে হতো না।

Facebook Comments Box

Posted ৮:১৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩

dainikbanglarnabokantha.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক

রুমাজ্জল হোসেন রুবেল

বাণিজ্যিক কার্যালয় :

১৪, পুরানা পল্টন, দারুস সালাম আর্কেড, ১০ম তলা, রুম নং-১১-এ, ঢাকা-১০০০।

ফোন: ০১৭১২৮৪৫১৭৬, ০১৬১২-৮৪৫১৮৬

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

design and development by : webnewsdesign.com

nilüfer escort coin master free spins