• শিরোনাম

    মোহন খানের গ্রামের নাম মাশুরগাঁও

    অনলাইন ডেস্ক রবিবার, ২৮ আগস্ট ২০২২

    মোহন খানের গ্রামের নাম মাশুরগাঁও

    apps

    ॥ নূরুদ্দীন দরজী ॥
    মাশুরগাঁও একটি গ্রামের নাম। বাংলাদেশের পঁয়ষট্টি হাজার গ্রামের একটি গ্রাম মাশুরগাঁও। বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জলার শ্রীনগর উপজেলার একটি সুন্দর পরিপাটি গ্রাম। আমি লিখতে চেষ্টা করছি একখানা বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে। বইখানির নাম,”গ্রামের নাম মাশুরগাঁও। এ বইয়ের লেখক সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহকারি প্রেস সচিব স্বনামধন্য মহিউদ্দিন খান মোহন। তাঁর এ বইয়ের বিষয়বস্তুতে রয়েছে মাশুরগাঁয়ের ঘটনা বহুল কাহিনী। লেখক গ্রামের আদিঅন্ত তুলে এনেছেন এ বইয়ে। জন্মগ্রহণ করা গ্রামের প্রতি মানুষের ভালোবাসা কত গভীর হতে পারে, গ্রামের নাম মাশুরগাঁও, বইখানা তার প্রমাণ। এ গ্রামের অলিখিত ছবি আঁকা রয়েছে মহিউদ্দিন খান মোহনের হৃদয় জুড়ে। অতুলনীয় প্রাকৃতির সৌন্দর্য বৈশিষ্ট্যে ধন্য গ্রামের ছেলেটি। গ্রামের পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে লেখকের শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও পরিপক্কতার ছোঁয়া। এ গ্রাম তাঁর সাধনা, আরাধনা এবং অস্থিত্বের মূলে। শৈশব হতে জীবন সায়াহ্নে এসে ও গ্রামের প্রতি লেখকের অকৃত্রিম প্রেম ও সীমাহীন ভালোবাসা। গ্রামের জন্য তাঁর মনের আকুতি শেষ হয় না।
    এক জীবনে দেখা ও আকুল করা গ্রামীন আবহ, শ্যামল প্রান্তর, সুনীল আকাশ, দিগন্তজোড়া মাঠ,আঁকা বাঁকা রাস্তা, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত আর বসন্তের অপরূপ শোভায় লেখক পাগলপারা। যে গ্রামে শুনা যায় রাখালিয়া বাঁশির সুর, ভাটিয়ালী গান, পাখিদের কুজন ও ঝিঁঝির ডাক। ছন্দে আনন্দে দোলা দেয় বৃষ্টির পশরা, কত না মধুর হয় শীতের কুয়াশা ভেজা পথে হাঁটা। মাশুরগাঁয়ের মাটি লেখকের নিকট অতিশয় প্রিয় ও পবিত্র । শৈশব থেকে কৈশোর আর যৌবনের হারিয়ে যাওয়া বর্ণিল দিনগুলা তাঁর হৃদয়ের সোনার খাঁচায় বন্দি। মা, বাবা, ভাইবোনসহ সমগ্ৰ পরিবার, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সাথে জীবন চলার পাথেয় ঘটনাবহুল স্মৃতিগুলো বেদনাবিধুর, কখনো বা মধুর হয়ে ধরা পড়েছে বার বার তাঁর কলমের আঁচড়ে। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মন্ডলী, সতীর্থ, সহপাঠি ও ফেলে আসা শিক্ষা জীবন ও শিক্ষাঙ্গনের অতীত স্মৃতিগুলো মধুময় হয়ে ঝংকৃত হয়েছে -স্পন্দিত করেছে তাঁর হৃদয় বীণার তন্ত্রীগুলোকে। জীবনে পাওয়া অনেক শিক্ষক মন্ডলীর আদর স্নেহের, শাসন সোহাগের ক্ষণগুলোকে ভুলতে পারেননি তিনি। ভুলে যাননি তাঁদের তিন জেনারেশনের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ওয়াজিউল্লাহ স্যারের কথা। বিভিন্ন সামাজিকতা, সাংস্কৃতিক পরিমণন্ডল, ঈদ, পূজাপার্বণসহ নানা অনুষ্ঠানাদিতে ও আপনজনদের নিয়ে কত যে কাজ তিনি করেছেন। তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে মা, খালা,চাচী, ফুপি, বোন ও ভাবীদের আদর স্নেহ ভালোবাসার হৃদয নিংড়ানো মুহূর্তগুলোর কথা। সময ও যুগের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যহীন ফুরিয়ে যাওয়া অনেক দ্রব্যাদি তাঁর মনকে নাড়া দিয়েছে বার বার। তৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতায় ও জীবন জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকা শহরের সাথে বিক্রমপুর তথা শ্রীনগরে লঞ্চে আসা যাওয়ার কষ্টের কথা। বাবা চাচাদের মুখে শুনেছেন বৃটিশদের শোষণের কথা, নিজের চোখে দেখেছেন, মনে আছে বর্বর পাকিস্তানীদের অমানবিক নির্যাতন ও স্বাধীনতার জন্য মুক্তি যুদ্ধের কথা। জীবনে দেখা অনেক রাজনীতির ঘটনাবহুল কাহিনী। বিগত হয়েছেন এমন অনেক নেতৃত্বের কথাবার্তা, জন সম্পৃত্ত কর্মসূচি, কর্মকান্ড এবং তাঁদের রেখে যাওয়া বক্তৃতা, ও স্থাপনাগুলোর কথা উঠে এসেছে তাঁর লেখনিতে ক্ষুরধার হয়ে। রাজনীতির জন্য তাঁর ও তাঁর পরিবারের অন্যান্যদের কর্মকান্ডের কথা তিনি তুলে ধরেছেন। যে মানুষ তার অতীত ও শৈশব মনে রাখতে পারে না জীবনে তার অভিজ্ঞতার কলস শূন্য থাকে। অনেকে বলেন, অতীত অতীতই। অতীতে প্রবেশ করলে স্মৃতির তাড়নায় মানসিক যন্ত্রনা বৃদ্ধি পায়। বনভাস্তে বলেছেন,”অতীতের যতকিছু ফেলে দাও অতীতে/তথাপি না দিও তারে পুনঃ আর্বিভাব হতে। যদিও অতীত নিয়ে আমরা বহু নেতিবাচক কথা শুনতে পাই। আবার অনেক মতে মানুষ অতীত মুখী ও অতীত বন্দনায় অভ্যস্ত। একজন ভালো মানুষ তিনিই যিনি খুব বেশি অতীত স্মৃতিধর। আর অতীতের ভিত্তি মূলেই ভবিষ্যতকে দাঁড়াতে হয়।
    গ্রামের নাম মাশুরগাঁও, বইতে লেখকের হাত ধরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে শত সহস্র মানুষের যৌবনের তরঙ্গ মালা। স্পন্দিত হয়েছে কত না জীবন প্রবাহ। অনুভূতি আর উপলব্ধিতে শিহরিত হয়েছে অতীত দিনের কথা। প্রান্তিক জনতার কথা ফুটে উঠেছে হৃদয়ের আকুতি ভরে। হারানো বিষয়গুলো উচ্ছাসিত ও জাগরিত হয়েছে লেখকের লেখনির বর্ণনা চ্ছ্বটায়। সমুদ্রের শান্ত ঢেউ যেন ফণা তুলে আবার আছড়ে পড়েছে মন মন্দিরের কোণে স্মৃতির আলেখ্যে। এপাশ ওপাশ, উত্তর-দক্ষিণ, পশ্চিম ও পূর্ব পাশে গ্রামের কোন কিছুই বাদ যায়নি তাঁর লেখার ছোঁয়া থেকে। কুসুমের ডালে তিনি মুকুলিত করেছেন তাঁর গ্রাম মাশুরগাঁওকে। সত্যিই “গ্রামের নাম মাশুরগাঁও, বইখানা পড়ার সৌভাগ্য যার হয়েছে তাকে অবশ্যই নিয়ে যাবে তার গ্রামের আঙিনায় শৈশবের মণিকোঠায়, অতীত স্মৃতির আবাহনে।
    যদিও আজ আমাদের অনেকের শৈশব, কৈশোর, ও যৌবনের গ্রাম বদলে যাচ্ছে। বিদ্যুতের ঝলকানি, ইলেকট্রিক পাখা, টেলিভিশন, ফ্রিজ এখন প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে। পাকা রাস্তা, দালানকোঠা, নানাবিধ যানবাহনের ধোঁয়া সর্বত্র। মুঠো ফোন, ডিশ, এন্টেনা, ইনট্রাগ্রাম, ইউটিউব ও ফেসবুকের বদৌলতে সয়লাব। আর এ সবে আচ্ছন্ন বর্তমান প্রজন্ম। হয়তো অদূর ভবিষ্যতের মানুষদের থাকবেনা গ্রামীন জীবন। তারা পাবে না মুক্ত গ্রামের নির্মল বাতাসের আবেশ মুগ্ধতা। আর পাওয়া যাবে না সহজ সরল ও নিরীহ মানুষগুলোকে। তারপর ও যদি কোথাও পাওয়া যায়- মাশুরগাঁয়ের মত গ্রাম, সেটি হবে সে প্রজন্মের মানুষদের জন্য ভাগ্যের বিষয়।
    মহিউদ্দিন খান মোহন তাঁর গ্রামের সবকিছু বর্ণনা করেছেন নির্দিধায়, নিঃসন্দেহে নিঃসংক চিত্তে। তাঁকে দেখেছি সব সময়ই স্পষ্ট কথা বলতে। ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে যতটুকু জানি তিনি স্পষ্টবাদী মানুষ। সারাটি জীবন থাকতে চেষ্টা করেছেন লোভ লালসার উর্ধ্বে। একটি রাজনৈতিক দলের আদর্শ বিশ্বাসী হয়ে সে দলের জন্য নির্লোভে কাজ করে গেছেন আজীবন। ব্যক্তিগত স্বার্থে নীতি ও আদর্শ জলাঞ্জলি দেননি কখনো। এক সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এর মত একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছিলেন। এমন পদে থেকে ও নিজের এবং আপনজনের জন্য কিছুই করেনি। ত্রিশ বছর আগে তাদের উপজেলায় চাকরি করার সুবাদে আমার পরিচয় হয়েছিল তাঁর সাথে। তখন থেকেই দেখে এসেছি । স্বীয় দলের প্রতিকুল অবস্থায় হোঁচট খেয়েছেন বার বার। প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতি আক্রমণ মোকাবেলা করে অনেক সময় ব্যথিত, বিধ্বস্ত এবং ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে ও দলের জন্য কাজ করে গেছেন জীবন ভর । আর এ সমস্ত কারণেই হয়তো বিধাতার অমোঘ বিধানে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন একটি উচ্চ পদে। সকল স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কাজ করেছেন সাধারণ মানুষের জন্য। এখন বোধ হয় রাজনীতিতে আর সক্রিয় নন ততটা। কিন্তু বসে বসে আরাম আয়শে থাকা খাওয়ার মত অবস্থা দেখিনা তাঁর চালচলনে কিংবা পরিবারে। চিন্তা করতে হয় নিজের ও পরিবারের অস্তিত্বের প্রশ্নে বেঁচে থাকার তাগিদে। অথচ তাঁর সমসাময়িক অনেকের দেখা যায় বিন্দু থেকে সিন্ধুর গভীরতা।
    মহিউদ্দিন খান এর বিভিন্ন পত্রিকার লেখা কলামগুলো পড়লে, টিভির টকশোতে তাঁর কথাগুলো শুনলে, ফেসবুক বা অন্যান্য মিডিয়ায় তাঁর উচ্চ গলার যুক্তি ও সংগতিপূর্ণ সত্য, ন্যায্য স্পষ্ট কথাগুলো লক্ষ্য করলে বুকে কাঁপুনি উঠে যায়। মনে প্রশ্ন জাগে কতদিন এমন কথা বলে তিনি টিকে থাকতে পারবেন? কিন্তু, না, তিনি বলেই যাচ্ছেন। কোন ভয়ভীতি তাঁর নীতি ও আদর্শের সিঁড়ি টলাতে পারছেনা। শেখ সাদী (রঃ) বলেছেন,” গরদান বেতমে’ বুলন্দ বুয়াদ,অর্থাৎ লোভহীন ব্যক্তির মস্তিষ্ক সর্বদা উঁচু থাকে। আর এমনটিই দেখা যাচ্ছে মহিউদ্দিন খান মোহন সাহেবের ক্ষেত্রে। গ্রামের নাম মাশুরগাঁও, প্রসঙ্গ যেটি আমার আলোচ্য বিষয়: গ্রামই মানব জাতির প্রথম নিবাস। কথায় আছে” গড মেড দি ভিলেজ এন্ড ম্যান মেড দি টাউন। গ্ৰাম্য প্রকৃতি, সুনির্মল বাতাস ও মানুষের ভালোবাসা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। পরিবার থেকে গ্রাম ও ক্রমান্বয়ে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা ও কামনায় স্বর্গ হয়। গ্রামের ধুলিকণা মাখা থাকে গায়ে, গ্রাম দেয় আলো বাতাস, মুখে অন্ন জল, পরণে বস্ত্র, দেয় শ্যামল স্নেহ, লালন করে সন্তান সম। তাই কৃতজ্ঞ মানুষের গ্রামের প্রতি থাকে মমত্ববোধ। জন্ম গ্ৰহণ করা গ্রামের প্রতি মানুষ চির ঋণী যার সুস্পষ্ট উদাহরণ মিলে মহিউদ্দিন খানের,”গ্ৰামের নাম মাশুরগাঁও, বইখানিতে।
    তাঁর বইখানা খুব বশি বড় নয়। তারপরও ১১০ পৃষ্ঠার বইতে প্রায় ২৫০ সহস্রাধিক বাক্যধীনে ১৫০০০ শব্দের সমাহার। আমার এ আলোচনা নিতান্তই সামান্য। তবে কিছটা উপলব্ধি করেছি তাঁর দেশপ্রেমের গভীরতা। এ মহা বিশ্ব এবং মহাকালের বিশালতায় একজন মানুষের যাপিত জীবনের ব্যাপ্তি অতি অল্প। চলে যাবো আমরা সবাই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু দেশ প্রেম শ্বাশত। এ প্রেমের চেয়ে বড় আর কিছুই হতে পারেনা। হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছন,”দেশপ্রেম ঈমানের অংশ। তিনি গ্রামের নাম মাশুরগাঁও, লিখে যথার্থ ও চমৎকার কাজটি করেছেন। মুন্সিগঞ্জের বৃহদাংশ সুপ্রাচীন কালের বিক্রমপুর ইতিহাস ঐতিহ্যের লীলাভূমি যেখানে খ্রিস্ট পূর্বাব্দে প্রায় আড়াইশত বছর বাংলার রাজধানী ছিল। বিক্রমপুরের মাটি গর্ববোধ করে অতীশ দীপঙ্কর, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, সরোজিনী নাইডু, চিত্তরঞ্জন দাস,বুদ্ধদেব বসু, বি চৌধুরী, চাষী নজরুলের মত অনেক কীর্তিমান সন্তান জন্ম দিয়ে। মহিউদ্দিন খানের কীর্তি, সততা ও আদর্শ তাঁকে স্থান দিবে বিক্রমপুরের কৃতি সন্তানদের পাশে এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। গ্রামের নাম মাশুরগাঁও, বইখানি তার এক অমর কীর্তি যা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে যুগের পর, পরচিতি এনে দিবে শতাব্দী হতে শতাব্দী পর্যন্ত। লেখাটি শেষ করবো অগ্নিযুগের একটি বিপ্লবী গানের অন্তরা দিয়ে। প্রখ্যাত গীতিকার মোহিনী চৌধুরী তাঁর দেশাত্মবোধক, মুক্তির মন্দির সোসান তলে, গানের অন্তরায় বলেছন, যারা স্বর্গ গত তাঁরা এখনো জানে/স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি। আমার মনে হয়েছে মহিউদ্দিন খানের, গ্রাম মাশুরগাঁও, তেমনি তাঁর প্রিয় স্থান ও প্রিয় জন্মভূমি। -লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষা অফিসার

    বাংলাদেশ সময়: ৮:৩০ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২৮ আগস্ট ২০২২

    dainikbanglarnabokantha.com |

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    রূপা

    ২৪ অক্টোবর ২০২০

    নায়িকা হয়েও কবি ছিলেন

    ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

    ছোটগল্প (দেনা)

    ২৫ জুলাই ২০২১

    আর্কাইভ