• শিরোনাম

    গাজীর এপিএসের নিয়ন্ত্রণে রূপগঞ্জের অপরাধজগৎ

    নিউজ ডেস্ক : বৃহস্পতিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩

    গাজীর এপিএসের নিয়ন্ত্রণে রূপগঞ্জের অপরাধজগৎ

    apps

    নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) এমদাদুল হক ওরফে দাদা এমদাদ। এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন গোটা উপজেলাজুড়ে। তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে থানায় অসংখ্য মামলা রয়েছে। অনুসন্ধান বলছে, চিহ্নিত এই সন্ত্রাসীদের নিয়ে তিনি জিম্মি করে রেখেছেন রূপগঞ্জকে।

    নিরীহ মানুষের জমি দখল, খুন, গুম, ধর্ষণসহ গুরুতর সব অপরাধ করে বেড়াচ্ছেন। রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ কেউ আইনের আশ্রয় নিলেও বিভিন্ন মামলার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। উল্টো মামলা করতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের রোষানলে পড়তে হচ্ছে।

    অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই এই সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যাঁরা এসব সন্ত্রাসীকে উসকে দিচ্ছেন, তাঁরা যত বড় দায়িত্বশীল পদে থাকুন না কেন, কোনোভাবে এসব অপরাধের দায় এড়াতে পারেন না। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে। না হলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নানা অনিয়ম করে পুরো নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

    এমদাদের সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে জিম্মি রূপগঞ্জের মানুষ

    রূপগঞ্জের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র এলাকার হাসমত দয়ার ছেলে শমসের আলী খান ওরফে ডাকু শমসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শমসেরের বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি ও মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে। নির্বাচনের আগেই রূপগঞ্জ থানায় হওয়া ১৩টি মামলার আসামি ছিলেন। ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এলাকায় প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি, গুম, খুন, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাঁর হাতে। চনপাড়ার বাসিন্দাদের মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে যুক্ত হতে বাধ্য করেন।

    সম্প্রতি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা সুমাইয়া আক্তারের (২০) ওপর অমানবিক নির্যাতন চালান শমসের। প্রকাশ্য দিবালোকে অস্ত্র হাতে মহড়া দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে আলোচিত চনপাড়া বস্তিতে ডনগিরি করছেন শমসের।
    মাছিমপুর এলাকার আফসার উদ্দিনের ছেলে তাওলাদ মেম্বার। এলাকায় নানা অপরাধকর্মকাণ্ড করে ত্রাস সৃষ্টি করেছেন। মন্ত্রীর এপিএস ‘এমদাদের লোক’ পরিচয়ে দেদার অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন। রূপগঞ্জ থানায় তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ডাকাতি, হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর, অবৈধ অস্ত্র বহন এবং মাদকের দুটি মামলা রয়েছে (নম্বর ১১(১০)২২ ও ২২(৮)২৩)। সোনারগাঁ থানায় আছে আরো একটি মামলা এবং সাধারণ ডায়েরি (জিডি)।

    একই এলাকার জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে শেখ ফরিদ মাসুমও নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন সময় সরকারি ও সাধারণ মানুষের সম্পদ লুটপাটের বিস্তর অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। এসব অপরাধের পাশাপাশি চাঁদাবাজি ও হত্যার হুমকির দায়ে রূপগঞ্জ থানায় রয়েছে চারটি মামলা (নম্বর ৯৯(৫)১৮, ২৭(৬)১৬, ৪১(২)০৩ ও ৩৫(১০)০৬)। বর্তমানে তিনি উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করছেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দল ও সংগঠনের নীতিবিরোধী বক্তব্য দিয়ে সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছেন।

    পূর্ব কালাদী গ্রামের সুরুজ মিয়া মুন্সীর ছেলে মো. আলী হোসেন ওরফে আলী বান্দা মন্ত্রীর এপিএস এমদাদের ছত্রছায়ায় নানা অপকর্ম করে যাচ্ছেন। তাঁর বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় একটি মামলা রয়েছে (নম্বর ৩৮(১২)২২)। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার একাধিক মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ভূমি দখল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ করেন। জানা গেছে, কাঞ্চন পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম রসুল কলির শিষ্য তিনি। তবে অপকর্ম করে বেড়ান এমদাদের ছত্রছায়ায়।

    রূপগঞ্জ উপজেলার মুড়াপাড়া ইউনিয়নে আরেক আতঙ্কের নাম তোফায়েল আহমেদ আলমাছ। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগে মামলা রয়েছে। সর্বশেষ মুড়াপাড়ার ব্রাহ্মণগাঁও গ্রামের তারা মিয়ার ছেলে যুবলীগ কর্মী সুমন মিয়া। তাঁকে দিনের বেলা প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে তোফায়েল আহমেদ আলমাছকে। এর আগেও এক ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে এবং এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় তাঁকে প্রধান আসামি করে মামলা হয়েছে। মুড়াপাড়ার শিল্পপতি রাসেল পার্কের স্বত্বাধিকারী রাসেল ভুঁইয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়। ফাঁসির আসামি হয়েও জেল থেকে ছাড়া পান তিনি। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সান্নিধ্য ও তদবির কাজে লাগিয়ে ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বনে যান তিনি। চেয়ারম্যান হওয়ার পর তাঁর চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আরো বেড়ে যায়। রূপগঞ্জ থানায় তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা রয়েছে।

    মাছিমপুরের মাদক ব্যবসায়ী, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী, লুটপাট, চাঁদাবাজি, হত্যার হুমকি, ইয়াবা ব্যবসায়ী মো. মামুন মিয়া। তাঁর বিরুদ্ধেও রূপগঞ্জ থানায় আছে বেশ কিছু মামলা। উল্লেখযোগ্য মামলার নম্বরগুলো হলো ৫৮(১)২৩, ১১(১০)২২, ১২(১০)২১ ও ১২(৮)২৩। রূপগঞ্জের চনপাড়ার আমেরিকান সিটির উত্তর পাশের ত্রাস খ্যাত আব্দুল মতিন। মন্ত্রীর এপিএস এমদাদের একান্ত সহযোগী হিসেবেও পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে আছে একাধিক মামলা। থানা সূত্র বলছে, সব মামলায় জামিনে আছেন তিনি। রূপগঞ্জ থানার এফআইআর নম্বর ২, পহেলা জুলাই, ২০২১ তারিখে করা অস্ত্র আইনে এজাহারভুক্ত আসামিও তিনি।

    মাছিমপুরের মাদক ব্যবসায়ী, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী, লুটপাট, চাঁদাবাজি, হত্যার হুমকিদাতা ও ইয়াবা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রনি মিয়া। রূপগঞ্জ থানার এজাহারভুক্ত আসামি তিনি। রূপগঞ্জ থানার মিরকুটিরছেও এলাকার বাসিন্দা মো. রাশেদুল থানায় করা অভিযোগে উল্লেখ করেন, চলতি বছর ৫ আগস্ট তারিখে তিনি মিরকুটিরছেও চৌরাস্তায় যাওয়ার পথে মো. রনির নেতৃত্বে পাঁচ থেকে ছয়জন জোটবদ্ধ হয়ে শানদা, রামদা, সুইচ গিয়ার, চায়নিজ কুড়াল, লোহার রড দিয়ে তাঁর গতিরোধ করে। তাঁকে খুন করার উদ্দেশ্যে ঘাড়ের ওপর পোঁচ দেয়। এতে তিনি জখম হয়ে রক্তাক্ত হন। এভাবে ত্রাস সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে মাঝেমধ্যেই রনি বিভিন্ন মানুষের ওপর হামলে পড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। কালাদী গ্রামের আনিসুর রহমান খোকন তাঁর শিষ্য বলে জানা গেছে। খোকনের বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় বেশ কিছু মামলা রয়েছে। কেন্দুয়া গ্রামের আব্দুল লতিফের ছেলে মতিউর রহমান। উঠতি বয়স থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন।

    রূপগঞ্জের কাঞ্চন গ্রামের বাসিন্দা শফিকুর রহমান মোল্লার স্ত্রী উম্মে কুলসুম ২০২২ সালের মার্চে রূপগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন। সেখানে কুলসুম অভিযোগ করেন, একই বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে মতিউরের নেতৃত্বে ৮-১০ জন জোটবদ্ধ হয়ে ধারালো অস্ত্র, রামদা, চাপাতি, লোহার রড, স্টিলের এসএস পাইপ, লাঠি ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তাঁর স্বামীর গতিরোধ করে ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এতে শফিকুর রহমান মোল্লার শরীরে জখম হয়। খুন করার উদ্দেশ্যে গলা চেপে ধরে ওই মামলার এক নম্বর আসামি গোলাম রসুল ধারালো রামদা দিয়ে খুন করার উদ্দেশ্যে সজোরে তাঁর স্বামীর মাথায় কোপ দেন। এতে ব্যাপক ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এলাকাবাসী বলছে, এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করাই তাঁদের উদ্দেশ্য।

    মাছিমপুরের আরেক ত্রাসের নাম আব্দুল হামিদ। চলতি বছর জুন মাসের ৪ তারিখে তাঁর কাছ থেকে পুলিশ অবৈধ অস্ত্র ও গুলি, চায়নিজ কুড়াল ও লোহার পাইপ জব্দ করে। রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া বাজার এলাকায় ডালিম মেম্বারের অফিসের পাশে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় একজন গুলিবিদ্ধ হয়, সেই ঘটনার খবর পেয়ে রূপগঞ্জ থানার সাব ইন্সপেক্টর শায়খ মাহমুদ রিয়াদের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে আব্দুল হামিদকে। পরে তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে অপরাধ বাড়িয়ে দেন। মাছিমপুরের সামসুল হকের ছেলে রাকিব ওরফে গুই, নসুর উল্লাহর ছেলে নোমান, কালাদী গ্রামের হাজী মোজাম্মেলের ছেলে লোহা শাহীনসহ বড় একটি সংঘবদ্ধ চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে রূপগঞ্জের আন্ডারওয়ার্ল্ড বলে অনুসন্ধানে উঠে আছে।

    রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) দীপক চন্দ্র সাহা বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমরা সব সময় সোচ্চার। সন্ত্রাসী যে-ই হোক তাকে গ্রেপ্তার করা হবে।’

    এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, ‘আমার কথা হচ্ছে, সন্ত্রাসী যে-ই হোক কোনো ছাড় নেই। রূপগঞ্জ উপজেলায় যারা সন্ত্রাসী ছিল, যারা নামকরা ছিল, তাদের সবাইকে আমরা গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। এর বাইরেও যদি কেউ থেকে থাকে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।’

    পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে মেসেজ এটাই যে অপরাধীদের কোনো ছাড় নেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের জিরো টলারেন্স। সেই ক্ষেত্রে তাকে যত দ্রুত সম্ভব আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

    এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মোবাইলে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি। তিনবার মোবাইল থেকে মেসেজ করা হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

    বাংলাদেশ সময়: ২:৪৮ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩

    dainikbanglarnabokantha.com |

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    আর্কাইভ