• শিরোনাম

    প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরপুর লীলাভূমি সাগর তো নয় তবু ও নাম রাম সাগর

    চিরিরবন্দর ( দিনাজপুর ) প্রতিনিধি মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর ২০২২

    প্রাকৃতিক সৌন্দর্য  ভরপুর লীলাভূমি  সাগর তো নয় তবু ও নাম রাম সাগর

    apps

    রামসাগর শুধু ঐতিহাসিক কীর্তিই নয় এটি প্রাকৃতিক শোভা ও সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমিও। দীঘির পাড়ের উচ্চ টিলার উপর অবস্থিত সুন্দর মনোরম ডাকবাংলোটি দেশি-বিদেশি অসংখ্য কৌতহলী পর্যটকের নিকট আকর্ষণ, তেমনি অনেক রসিক ব্যক্তির নিকেতনও বটে। এই দীঘির মুগ্ধ ও সিগ্ধি পরিবেশে শ্রান্তি ও ক্লান্তি বিনোদনের জন্য সারা বছরে অগণিত ক্লান্ত মানুষ ছুটে আসেন। সাগরের পানির মত নীল পানি বক্ষে ধারণ করে হ্রদের বিশাল বিস্তৃতি নিয়ে এটির অবস্থান।
    সাগরের মতো বিশাল না হলেও হ্রদের মতো বড়। দিনাজপুর শহর হতে মাত্র আট কিলো মিটার দুরে এই দীঘির পানিতে মিশে রয়েছে এক অন্যান্য ইতিহাস আর কিংবদন্তি। দিনাজপুরে ভ্রমণকারীদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান রামসাগর। দীঘির চার পাশ ঘিরে রয়েছে লাল মাটির ছোট ছোট টিলা। এর পরেই সবুজ প্রান্তর। পার্ক ভূমিসহ দীঘির আয়তন ৪ লক্ষ ৩৭ হাজার ৩১ মিটার, প্রস্থ ৯ শত ৯৮ ফিট। গভীরতা গড়ে প্রায় ১০ মিটার। রামসাগর শুধ দিনাজপুরের নয় বাংলাদেশের দীঘি গুলির সর্বশ্রেষ্ঠ। এই দীঘিকে নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে বহু কিংবদন্তি ও উপাখ্যান। ইতিহাসের চাইতে সাধারণ মানুষ কিংবদনতীকেই বিশ্বাস করে বেশী।

    কিংবদন্তি অনুসারে পুরাকালে এই অঞ্চলে এক রাজা ছিলেন নাম- প্রাণ নাথ। সুশাসক ও প্রজাপ্রিয় রাজা বলে তার দেশ-জোড়া খ্যাতি ছিল, আর ছিল অফুরন্ত ধন-সম্পদ। কিন্তু মনে ছিল না তার শান্তি। কারণ রাজার ছিল না কোন পুত্র সন্তান। বহু যাগযজ্ঞ ও দান দক্ষিণার ফলে অবশেষে দৈব কৃপায় রাজার ঘরে জন্ম নিল এক পুত্র সন্তান। নাম রাখা হল রাম নাথ। যুবরাজ রাম যখন যৌবনে পদার্পন করল, তখন দেশ জুড়ে নেমে আসে প্রকৃতির নিষ্ঠুর তান্ডব। শুরু হলো একটানা অনাবৃষ্টি ও খরা। গোটা মৌসুমে এক ফোঁটা পানিও পড়ল না আকাশ হতে। অনাবাদি রইল মাঠ। ফসল বা শস্য পাওয়া গেল না এক মুঠোও। দেশ জুড়ে দেখা দিল প্রচন্ড খাদ্যভাব। অনাহারে মারা গেল শত শত মানুষ। জগণের জন্য খুলে দেওয়া হল রাজভান্ডার।
    এতে খাদ্য সমস্যা সমাধান হলেও দেখা দিল পানীয় জলের অভাব।
    দীর্ঘ দিনের অনাবষ্টি ও খরায়-খাল বিল, দীঘি নালা শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। একফোটাও পানি নাই কোথাও। রাজ্য জুড়ে শুরু হলে পানির জন্য আহাজারি। এমন পরিস্থিতিতে রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন এক বিরাট দীঘি খনন করার। শুরু হল দীঘি খনন। হাজার হাজার শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রক করে মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে খনন করল এক সাগর তুল্য দীঘি। কিন্তু এত গভীর খনন করা সত্ত্বেও দীঘির বুকে এক ফোটা পানিও আসল না। হতাশা ও দুর্ভাবনায় বৃদ্ধ রাজা আহার নিদ্রা ত্যাগ করলেন। তার মৃত্যুর আশস্কায় ঘরে ঘরে শুরু হল কান্নার রোল। একদিন রাজা স্বপ্নে দৈববানী পাইলেন তার একমাত্র পুত্র রামকে খনন করা দীঘিতে বলি দিলে পানি উঠবে। রাজার মুখে স্বপ্নাদেশ শুনিয়া সারা রাজ্যে নেমে আসল শোকের ছায়া কিন্তু রাজপুত্রের মনে কোন বিকার নাই। নিজের প্রাণের বিনিময়ে প্রজাদের জীবন রক্ষা করতে রাজকুমার অবিচল। তার নির্দেশ ক্রমে দীঘির মধ্যস্থনে একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করা হ’ল। এর পর গ্রামে গ্রামে ডাক ঢোল সহরত বাজাইয়া প্রজাদের জানানিয়ে দেওয়া হ’ল আগামী কাল ভোরে দীঘির বুকে পানি উঠবে। পরদিন ভোর না হতেই রাজবাড়ীর সিংহদ্বার খুলে গেল। বেজে উঠল কারা নাকাড়া। হাতির পিঠে চড়ে শুভ্রবসন পরিহিত যুবরাজ যাত্রা শুরু করলেন সেই দীঘির দিকে। দীঘির পাড়ে পৌঁছে যুবরাজ রামসিড়ি ধরে নেমে গেলেন মন্দিরে। সঙ্গে সঙ্গে দীঘির তলদেশ হতে অৎস্র ধারায় পানি উঠতে শুরু করল। চোখের পলকে পানিতে ভরে গেল বিশাল দীঘি। পানিতে ভেসে উঠল রাজ কুমারের মুকুট। যুবরাজ রামের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে দীঘির নাম রাখা হ’ল ‘রাম সাগর’।

    দিনাজপুরের বিখ্যাত রাজা রামনাথ কর্তৃক রাম সাগর দীঘি খনন হয়। রামনাথ ছিলেন দিনাজপুর রাজবংশের শ্রেষ্টতম নৃপতি। তিনি ১৭২২ খৃষ্টাব্দ হতে ১৭৬০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত দিনাজপুরে রাজত্ব করেন। দিনাজপুর রাজ বংশের ইতিহাসের সাথে ১৭৫০ হতে ১৭৫৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যে অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধে অব্যবহিত পূর্বে রাম সাগর দীঘি খনন হয়। রাজা রাম নাথের শক্তি ও সম্পদের অন্যতম অতুল্য কীর্তি হতে খনন হয় দেশ বিখ্যাত রাম সাগর দীঘি। পশ্চিম পাড়ের ঠিক মধ্যস্থলে সুপ্রশস্ত পাষান বাধান দীঘির প্রধান পাকা ঘাট অবস্থিত। ঘাটের দৈর্ঘ্য ১৫০ ফুট এবং প্রশস্থ ৬০ ফুট। ঘাটের চারিদিকের পাড় দেয়াল ও পাটাতন সবটাই পাষাণমন্ডিত। প্রধান সোপান হতে ১০ ধাপে ঢারু থেকে ১৫ ফুট প্রশস্ত সোপান গুলি ক্রমাবনতভাবে পানির গভীর নেমে গেছে। রাম সাগরে একটি পাথর ঘাট রয়েছে। যা প্রায় ৬ হাজার বর্গফুট আয়তকার ভাবে নির্মিত ঘাটটির সঙ্গতি দীঘির বিশালতার সঙ্গে বিশেষ সামঞ্জস্যপূর্ণ আকারে দীঘিটি যেমন বিরাট সে অনুপাতে বিরাট দীঘির পাষাণ বাঁধা ঘাটটিও। বৃহৎ বৃহৎ সাইজ করা বেলে পাথর দিয়ে ঘাটটি নির্মিত।
    বলা বাহুল্য যারা দীঘি দেখতে আসেন তাদের অনেকেই পরশ কৌতুহল পরবশ হয়ে এই ভগ্ন নগ্ন সৌধটিও দেখে যান। প্রতœতাত্বিক অন্বেষা ও অনেকের মনে জাগ্রহ হয়। রাম সাগর দিনাজপুরের বন বিভাগের আতায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বন বিভাগ এখানে প্রায় ৪ শ’ প্রজাতির বৃক্ষ রোপন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ২ শ প্রজাতির উন্নতমানের গোলাপ। দীঘির চার পার্শ্বে প্রায় আড়াই কিলোমিটার সড়কের দুই ধারে লাগানো হয়েছে দেবদারু, ঝাউ, আম ও মুছকন্দ ফুলের গাছ। দুই একর জমির উপর নির্মিত হয়েছে কৃত্রিম শিশু পার্ক। এই পার্কে জিরাপ, বনবানর, ভাল্লুক, হাতিসহ প্রায় ২০টি প্রাণীর রয়েছে। রাম সাগরকে পর্যটনের আওতায় নিয়ে আসার পর বন বিভাগ ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম করেছে। গড়ে উঠেছে একটি আধুনিক দ্বিতল ডাক বাংলোসহ ৭টি পিকনিক কর্ণার। রয়েছে ক্যাফেটোরিয়া বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য বসানো হয়েছে গভীর নলকুপ। রয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। দেশী বিদেশী পর্যটকদের নিকট রামসাগরকে আরও আকৃষ্ট করার জন্য বর্তমান সরকার উন্নয়নের জন্য টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। এই উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে ঝুলন্ত সেতু, পানির উপর উন্নতমানের ক্যাফেটোরিয়া, ৪০ আসন বিশিষ্ট ডরমিটরি মিনি ট্রেন প্রভৃতি। রামসাগরে প্রতি বছর প্রায় ২ লক্ষ দেশী দর্শনার্থী ও পর্যটন আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এতে সরকারের মোটা অংকের টাকা আয় হবে।

    বাংলাদেশ সময়: ১১:০৩ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর ২০২২

    dainikbanglarnabokantha.com |

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    আর্কাইভ