• শিরোনাম

    ই-বর্জ্যের সোনা-রুপার মতো দামি ধাতু কেন যাচ্ছে বিদেশে

    রাহিমা আক্তার রিতা রবিবার, ২৭ মার্চ ২০২২

    ই-বর্জ্যের সোনা-রুপার মতো দামি ধাতু কেন যাচ্ছে বিদেশে

    apps

     

     

    সংগৃহীত ই-বর্জ্য তিনটি ধাপে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হয়—চূর্ণ করা (ডিজমেন্টাল), যন্ত্রাংশ আলাদা করা (সেগ্রেগেশন) ও যন্ত্রাংশের প্রতিটি ধাতু আলাদা করা (সেপারেশন)। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রথম দুটো করলেও ধাতু আলাদা করার কাজটি পুরোপুরি করে না, বিশেষ করে মূল্যবান ধাতু। ফলে ই-বর্জ্য সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিবছর কয়েক শ টন পিসিবি, র‍্যাম বিদেশে রপ্তানি করতে হচ্ছে।

     

    বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েটের) এক গবেষণা বলছে, প্রতি টন পিসিবি ও র‍্যাম থেকে ৬০০ গ্রাম স্বর্ণ আলাদা করা সম্ভব। এর বর্তমান বাজারমূল্য ১৯ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। বুয়েটের সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট গবেষণাটি পরিচালনা করে ২০১৮ সালে। গবেষণায় হাইড্রো মেটালার্জিক্যাল প্রক্রিয়ায় স্বর্ণ, রুপা, কপার ও টিন উত্তোলন করা হয়। এ ছাড়া প্রতি টনে রুপা পাওয়া যায় ৭ দশমিক ৬ কেজি, বর্তমান বাজারমূল্যে যা ৩ লাখ টাকার মতো। আর এক টন পিসিবি ও র‍্যামে কপার পাওয়া গেছে ১৩৬ দশমিক ৩৫ কেজি, যার মূল্য ১ লাখ ১৭ হাজার টাকার মতো। এ ছাড়া টিনের পরিমাণ ২৪ কেজি, এর বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৬২ হাজার টাকা।

    গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন বুয়েটের বস্তু ও ধাতবকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ফাহমিদা গুলশান। তিনি বলেন, ‘দেশে ই-বর্জ্যের মূল্যবান ধাতুর বড় অংশ দেশের বাইরে রপ্তানি করে দেওয়া হচ্ছে। আর না হলে যেখানে-সেখানে ফেলে দিয়ে অপচয় করা হচ্ছে। কিন্তু ধাতুগুলো আলাদা করে বিক্রি করতে পারলে দেশ লাভবান হতো।’ তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বাংলাদেশে এ নিয়ে গবেষণা হলো এই প্রথম। এমনকি মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে কোনো সচেতনতা নেই।

     

    কোন পণ্যে কী পরিমাণ ধাতুপরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পাওয়া এসব রিসাইক্লিং প্রতিষ্ঠান ৫টি—আজিজু রিসাইক্লিং অ্যান্ড ই-ওয়েস্ট কোম্পানি লিমিটেড, জেআর রিসাইক্লিং সলিউশন লিমিটেড, ইউসুফ এন্টারপ্রাইজ, জামান এন্টারপ্রাইজ এবং এনএইচ এন্টারপ্রাইজ।

     

    মূল্যবান ধাতুর পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে এসব প্রতিষ্ঠান পিসিবিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে—এ প্লাস, এ, বি প্লাস, বি ইত্যাদি। এর মধ্যে এ গ্রেডের পণ্য মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক বোর্ড, মোবাইল ফোন, সার্ভার ইত্যাদি। ‘বি গ্রেড’-এর পণ্য কম্পিউটার, চীনে তৈরি স্বল্পমূল্যের মোবাইল ফোন।

    দেশে উৎপাদিত ই-বর্জ্যের বেশির ভাগই বি গ্রেডের বলে জানান আজিজু রিসাইক্লিং অ্যান্ড ই-ওয়েস্ট কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আবুল কালাম আজাদ। আর মোবাইল ফোনের পিসিবিতে স্বর্ণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এক টনে স্বর্ণ ও প্ল্যাটিনাম মিলিয়ে ৫০০ গ্রামের বেশি থাকে বলে জানান আবুল কালাম।

    এরপরই রয়েছে মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক বোর্ডে। এর ১ টন পিসিবিতে স্বর্ণ ও প্লাটিনাম মিলিয়ে থাকে প্রায় ৪০০ গ্রাম। এ ছাড়া কম্পিউটারে প্রতি টনে ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম।

    রুপা মূলত বেশি থাকে টেলিকম নেটওয়ার্ক বোর্ডে, ১০ টনে ৪ কেজির মতো—জানিয়েছেন আজিজুর চেয়ারম্যান।

     

    কোথা থেকে আসে পিসিবি, র‍্যাম

    দেশে দুইভাবে সংগ্রহ করা হয় ই-বর্জ্য। বিদেশি পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অথবা দেশের ভেতরেই সরাসরি নিলামের মাধ্যমে।

     

    জেআর রিসাইক্লিং সলিউশন লিমিটেডের কথা ধরা যাক। প্রতিষ্ঠানটি এসআইএমএস (সিমস) রিসাইক্লিং সলিউশন লিমিটেড নামক একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশি এজেন্ট। ধরুন, নকিয়া ২০০ টনের মতো যন্ত্রপাতি নিয়ে এল মুঠোফোন কোম্পানিগুলোর জন্য। ১৮০ টন বিক্রি করে ফেলেছে, ত্রুটিপূর্ণ বা উচ্ছিষ্ট ২০ টন রয়ে গেল। সেগুলো সিমসকে কিনতে বলা হলো। সিমস আবার তা পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করার দায়িত্ব দিল জেআর-কে।

    এর বাইরে দেশের ভেতরে নিলামে ই-বর্জ্য কেনে দেশীয় পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলো। এর একটা বড় অংশ আসে মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। মূলত আজিজু ও জেআর এসব প্রতিষ্ঠানের থেকে ই-বর্জ্য বেশি পায়।

    জেআর-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ হোসাইন বলেন, মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক কোম্পানিগুলোর অ্যানটেনা, ওডিও, আইডিও যন্ত্রগুলোর পিসিবিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সোনা, রুপা, ক্রোমিয়াম, প্লাটিনাম থাকে। একটা ওডিওর ওজন হয় ১০ থেকে ১৫ কেজি।
    এ ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের সিমকার্ডও বিক্রি হয়। সব মোবাইল ফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠান সিমকার্ড আমদানি করে। নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রি না হওয়া ও ত্রুটিপূর্ণ সিমগুলো পায় ই-বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা প্রতিষ্ঠানগুলো।

    এম এ হোসাইন বলেন, এ বছর রবির ৩১ লাখ সিম তাঁরা পাবেন। সিমের অধিকাংশেই স্বর্ণের প্রলেপ থাকে। এ ছাড়া মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী স্যামসাং, ভিভো, টেকনো, সিম্ফনির সঙ্গে চুক্তি আছে জেআর রিসাইক্লিং সলিউশন লিমিটেডের। ফোন তৈরির সময় কিছু নষ্ট হয়। চলতি নভেম্বরে ভিভোর কাছ থেকে ১ টন উচ্ছিষ্ট পিসিবি পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

     

    ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু পুনরুদ্ধারে পাইরো মেটালার্জিক্যাল (তাপ প্রয়োগে গলানো) কিংবা হাইড্রো মেটালার্জিক্যাল (অ্যাসিডে দ্রবীভূত করে) পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।

    বুয়েটের গবেষক ফাহমিদা গুলশান বলেন, সংগৃহীত ই-বর্জ্যের মধ্যে কী কী উপাদান আছে, তা নির্ণয় করা হয়— অ্যাটমিক অ্যাবজরপশন স্পেকট্রোসকপি (এএএস) ও এক্স-রে ফ্লুরোসেন্স স্পেকট্রোসকপি (এক্সআরএফ) উপায়ে। এরপর এই বর্জ্যকে অ্যাসিডে দ্রবীভূত করে মূল্যবান সব ধাতু পুনরুদ্ধার করা হয়।

    বুয়েটের বস্তু ও ধাতবকৌশল বিভাগে অ্যানালাইসিস ল্যাব এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (বিসিএসআইআর) পৃথকভাবে গবেষণাগুলো করা হয়।

    অধ্যাপক ফাহমিদা গুলশান বলেন, খুব দক্ষ লোক দিয়ে এটা বের করতে হয়। কারণ, পিসিবি ও র‍্যামে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, পারদ, সিসার মতো ক্ষতিকর পদার্থও আছে। গলানোর জন্য শক্তিশালী ‘অ্যাকুয়া রিজিয়া’ কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয়। তাই যেকোনো উপায়ে বের করলে হবে না।

    মূল্যবান ধাতুর রপ্তানি মূল্য কেমন

     

    দেশের ই-বর্জ্যের পিসিবি, র‍্যাম মোট কী পরিমাণ রপ্তানি হয়, তার নির্দিষ্ট হিসাব নেই। তবে বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া গেছে কিছু তথ্য।
    বেশি স্বর্ণের প্রলেপ পিসিবির রপ্তানি মূল্য তুলনামূলক বেশি—প্রতি টন ১০ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন আজিজুর চেয়ারম্যান মো. আবুল কালাম আজাদ। আর কম হলে তা ৬ লাখ টাকায়ও রপ্তানি হয়। তিনি জানান, বছরে তাঁর প্রতিষ্ঠান ১২০ থেকে ১৮০ টন পিসিবি সংগ্রহ করে।

    এদিকে জেআর রিসাইক্লিং সলিউশন লিমিটেড বছরে ৫০ থেকে ৬০ টন পিসিবি রপ্তানি করে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ হোসাইন বলেন, ৯০০ টাকা কেজিতে কিনলে তা ১৬০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। অর্থাৎ টনে হিসাবে রপ্তানি মূল্য ১৬ লাখ টাকা।

    মাইক্রোপ্রসেসরের কেজিতে বিক্রয়মূল্য ১৩০০ থেকে ১৬০০ টাকা বলে জানিয়েছেন এম এ হোসাইন। বি গ্রেডের (কম্পিউটার ও চায়না মোবাইল ফোন) পিসিবিগুলো কেনা হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজিতে। কাজেই এর রপ্তানিমূল্য কিছুটা কম।
    জেআর রিসাইক্লিং সলিউশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘মূল্যবান ধাতু বের করতে পারলে লাভ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেত।’

     

    কেন হচ্ছে না দেশে

     

    দেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পাওয়া পাঁচটি প্রতিষ্ঠান মূল্যবান ধাতু পুনরুদ্ধার না করলেও, এর বাইরে কেউ কেউ পরিবেশ ছাড়পত্র না নিয়েই এ কাজ করছে। জেআর রিসাইক্লিং সলিউশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অভিযোগ করেন, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ও রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে কিছু ব্যক্তি পিসিবি, র‍্যাম থেকে শুধু স্বর্ণ আলাদা করেন।

    কেন আপনারা এ কাজ করেন না, এ প্রশ্নের জবাবে আজিজুর চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ কাজে প্ল্যান্ট স্থাপন ও পরিচালনায় অনেক দক্ষ লোক দরকার, যা দেশে নেই। আজিজুর কারখানা আরও প্রসারিত হচ্ছে, যেখানে যুক্ত হবে আরও প্রযুক্তি। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে তারা মূল্যবান ধাতু আলাদা করার উদ্যোগ নিতে পারেন বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

    অন্যদিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১’-এ পিসিবি রপ্তানির নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নেই উল্লেখ করে এম এ হোসাইন বলেন, ‘সরকার পিসিবি রপ্তানি বন্ধ করে দিক। আমি অনেক খরচ করে (মূল্যবান ধাতু পুনরুদ্ধারে) প্ল্যান্ট করলাম। পরে যদি দেশে কাঁচামাল না পাই, বাইরে চলে যায়, তাহলে তো লোকসান হবে।’

     

    এমন পরিস্থিতিতেও দেশে মূল্যবান ধাতু আলাদা করার প্রক্রিয়া অনেকটাই এগিয়েছে বলে জানিয়েছেন এম এ হোসাইন। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) একজন সদস্যও তিনি।

    এম এ হোসাইন বলেন, ২ হাজার ১৪৫ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তায় একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালু করার কথা ভাবছে বিশ্বব্যাংক। এ প্রকল্পে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে প্ল্যান্ট স্থাপনের একটি প্রস্তাব পেয়েছে জেআর রিসাইক্লিং সলিউশন লিমিটেড। সঙ্গে রয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ও। পরীক্ষামূলক এ প্রকল্প ২০২২ সাল নাগাদ শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি পরীক্ষামূলক প্রকল্পে যাব। কিন্তু পিসিবি রপ্তানি বন্ধ না করলে প্ল্যান্ট স্থাপনের পর আমি পর্যাপ্ত কাঁচামাল না পেলে কী করব?’

    বাংলাদেশ সময়: ১:৫৫ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২৭ মার্চ ২০২২

    dainikbanglarnabokantha.com |

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    আজ বিজয়া দশমী

    ২৬ অক্টোবর ২০২০

    আর্কাইভ