
নূরুদ্দীন দরজী | সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | প্রিন্ট
সমাজে নারী পুরুষ সমানভাবে বসবাস করে। তাঁদের পারস্পরিক সহযোগিতা ব্যতীত মনুষ্য সমাজ চলতে পারে না। পুরুষের মত নারীরা ও জড়িয়ে আছে সবার সাথে সবার মাঝে অঙ্গাঙ্গীভাবে। একজন আরেক জনকে সহযোগিতা না দিলে কাজের সফলতা আসে না। এমন কি যুদ্ধ ক্ষেত্রে ও কোন না কোন ভাবে নারীরা এসে পুরুষের পাশে দাঁড়ায়, নানা উপায়ে সহায়তা দিয়ে যায়। নারীর সহযোগিতা ব্যতিত যুদ্ধ জয় করা যায়না। পৃথিবীর যত বড় যুদ্ধ, আর যত বিজয় নারী তাতে অংশীদার।
কবি কাজী নজরুল ‘তাঁর ‘নারী কবিতায় বলেছেন,
” কোন কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারী/ প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয়া লক্ষ্মী নারী।,
১৯৭১ সালে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি নারীর অবদান অনস্বীকার্য। ওই সময় নারীরা শারিরীক, মানসিক ও বহুবিধ নির্যাতন সহ্য করে পুরুষের পাশে থেকেছেন। আবার অনেকে যুদ্ধে সহায়তা করতে গিয়ে নিজেদের সবকিছু হারিয়েছেন। মান সম্মানের বলয় ভেঙ্গে অনেকেই পরবর্তীতে তাঁদের পরিচয় গোপন রেখেছেন। যেভাবে অনেকেই রয়ে গেছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
এর মূল কারণ একজন নারীর সম্মান/ সতিত্ব হারানো বুলেটের আঘাতের চেয়ে মোটেও কম নয়। নারী জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে যুদ্ধ করলে ও মানুষ তাঁকে পঙ্কিল ভেবে অবমূল্যায়ন করতে পারে। সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না – কথাটি চিন্তা করে অনেক নারী দেশ অথবা সমাজ ত্যাগ করেছেন । অতীতের সুন্দর জীবনে আর ফিরে আসেননি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সবুজ ও শ্যামল বাংলার অনেক অবলা নারী সশ্রদ্ধ যুদ্ধে অবর্তীন হতে বাধ্য হয়েছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রশিক্ষন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন, পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকেছেন। এ ছাড়া তাঁরা কলকাতার ‘গোবরা, ও আগরতলার ‘লেঙ্গুছড়া, ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ গ্ৰহণ করে দেশে ফিরে যুদ্ধে নেমেছেন। গেরিলা যুদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। ক্যাম্প হতে ক্যাম্পে, স্থান থেকে স্থানে,এক কমান্ডার হতে অন্য কমান্ডারের নিকট তথ্য সরবরাহ করেছেন। তারামন বিবি,কাকন বিবি এবং সিতারা বেগমের মত অনেক নারুী যুদ্ধ ক্ষেত্রে ভয়ংকর ও দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করেছেন।
প্রত্যক্ষ ভাবে ছাড়া ও বাংলার নারীরা পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে চিকিৎসা দিয়েছেন, একান্তভাবে সেবা দিয়েছেন। খাবার খাওয়ানো ও ঘুমানোর জায়গার ব্যবস্থা করেছেন। মেয়েরা অনুপ্রেরণা, মমতা,আদর স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে দেশাত্ববোধ জাগ্ৰত করেছেন। বহু মা তাঁর ছেলেকে,বোন ভাইকে,স্ত্রী স্বামীকে দেশ মাতৃকার ডাকে সাড়া দিতে যুদ্ধে যেতে উদ্ভুদ্ধ করেছেন। অনেক লেখিকা,গায়িকা, অভিনেত্রী বিভিন্ন ভাবে অনুষ্ঠান করে যুদ্ধের জন্য অর্থ যুগিয়েছেন।
আবার অনেক নারী সুকৌশলে পাকিস্তানি হানাদারদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে নিজেদের আয়ত্বে এনে নাস্তানাবুদ করেছেন। অনেক সময়ই মেয়েদের নিকট তারা ও তাদের দোসর রাজাকাররা অসহায় হয়ে পড়েছে । মা, ডেকে, বোন বলে নিজেদের জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করেছে । এমন অনেক ঘটনা আমরা আমাদের অনেক নাটক সিনেমায় দেখতে পাই। এ সব দেখে হাসির উদ্রেক হলে ও ঘৃনায় মন ঘৃনায় ভরে উঠে।
-এ সমস্ত অজস্র কর্মকান্ডের পর ও একাত্তরের যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অনেক অসহায় অবলা নারীকে বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। হানাদারদের সহায়তাকারী এ দেশীয় পাপিষ্ট রাজাকার, আলবদরদের প্ররোচনায় পড়ে বেনিয়াদের ক্যাম্প তাঁদের সব কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে। তাঁরা সভ্রম হারিয়েছেন, দীর্ঘ দিন তাদের ক্যাম্পে বন্দী থেকে কঠিন মানবেতর সময় কাটাতে হয়েছে। হানাদাররা বেইজ্জত করে করে অনেক বাঙালি মা, বোনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। অনেকের গর্ভে অবৈধ সন্তান ধারণ করতে হয়েছে। গর্ভপাত করতে গিয়ে বহু নারীকে জীবন ও দিতে হয়েছে। কখনো বা কারো কারো সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়ে পড়তো যা ছিলো তাঁদের জন্য মারাত্মক সমস্যা । যুদ্ধের পর এমন শিশুদের নাম দেওয়া হয় ‘ যুদ্ধশিশু। কিন্তু সমাজের লাজ লজ্জার ভয়ে তাঁদের রাখা হয়েছে পর্দার অন্তরালে। এমন অনেক গর্ভধারিণী মা অপার মাতৃস্নেহের কারণে শিশুদের নিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে জীবন কাটিয়েছেন। একাত্তরে যুদ্ধে জন্মগ্রহণ করা শিশুদের পাশে এসে দাড়িয়েছিলো ‘ মাদার তেরেসা শিশু সদন।, এ সংস্থার মাধ্যমে ১৫ জন শিশুকে দত্তক দেওয়া হয়েছিলো ১৪ টি হৃদয়বান দম্পতির নিকট। তাঁদের জন্ম পরিচয় বাকী জীবনে সম্ভবত গোপনই রয়ে গেছে।
এত বিসর্জন যারা দিলেন, এত এত ত্যাগ স্বীকার করে জীবন দিয়ে ও আত্মসম্মানের ভয়ে আজীবন তাঁরা সমাজ থেকে বিচ্যুত রয়ে গেছেন । যাঁদের অগনিত অবদান, বীরত্ব কাহিনী ও অমর গাথা আজো তেমনভাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ফুটে উঠেনি, উঠে আসেনি । মনে করা হয় এখনো আড়ালে আবডালেই লুটোপুটি খায় ওই সমস্ত মা বোনদের আত্নত্যাগের বীরত্ব গাথা। আর এ কারণেই হয়তো দীর্ঘ দিন চাপা পড়েছিলো তারামন বিবিদের মত অনেক জীবন ও যুদ্ধ কাহিনী।
বাঙালির স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি না্রীদের ভূমিকা অনেক । তাঁরা আত্মসম্মান ও সভ্রম হারিয়েছেন দেশের জন্য। অনেক সময়ই হয়ে পড়েন অবলা। কিন্ত তাঁরা যে মায়ের জাতি। মায়েরা কখনো অপবিত্র হতে পারে না, তাঁরা ভোরের শিশিরবিন্দুর মত স্বচ্ছ । মায়েরা প্রতিদিন সূর্যের আলোতে প্রজন্মান,তাঁরা সুভ্র শিশির।
লেখক: নূরুদ্দীন দরজী, কলামিস্ট ও সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার
Posted ৪:১২ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
dainikbanglarnabokantha.com | Shanto Banik
এ বিভাগের আরও খবর
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।