রবিবার ২৭ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

>>

স্বাধীনচেতা বাঙালি জাতির কিছু গৌরবগাঁথা

টিইও নূরুদ্দীন দরজী   |   বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫   |   প্রিন্ট

স্বাধীনচেতা বাঙালি জাতির কিছু গৌরবগাঁথা
যুগে যুগে শক্তিশালী জাতি ও দুর্ধর্ষ ব্যক্তিরা  দুর্বল মানুষদের আক্রমন ও  পরাজিত করে এসেছে । কোন কোন ভূ-খন্ডে স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণভাবে  বসবাসকারী মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে তাদের পরাধীন করে রেখেছে। অনেকে পরের সম্পদ অর্জনে  ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছে। বহু দেশকে পরাধীন করে উপনিবেশ বানিয়েছে। নানা জাতি ও বর্ণের মানুষকে  রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত করে অর্থনৈতিক শোষণ করেছে। যদিও এমন বহুবিধ পরগ্ৰাসী ঘটনার শিকার হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ, কিন্তু তাঁরা সহজে সবকিছু ছেড়ে দেয়নি। প্রতিবাদী হয়েছে, প্রতিরোধ করে  অনেক বীরত্ব দেখিয়েছে।
 -মোটামুটি সারে তিন হাজার বছরের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, গাঙ্গেয় এ বদ্বীপে বসবাসকারী মানুষ স্বাধীনচেতা ছিল। তারা অন্যায় ও জুলুমকারীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে বার বার । সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলাদেশকে যারাই  উপনিবেশ বানাতে চেষ্টা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ  চরম প্রতিবাদী হয়েছে। সেই খ্রিস্টপূর্বাব্দ শুরু করে  এখানকার মানুষ সব সময়েই ছিল স্বাধীনচেতা এবং চাক্ষুষ প্রতিবাদী।
প্রাচীন কালে মোর্য, গুপ্ত ও সেনদের অধীন ছিল বাংলাদেশ। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ছিল  দিল্লির সালতানাত ও মোঘল সাম্রাজ্যের অধীন। কিন্তু পুরোপুরি উপনিবেশ ছিল বলা যায় না। আবার ষোড়শ শতাব্দীর পর পর্তুগিজরা চট্রগ্রাম ও নোয়াখালী, ডাচরা নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনা,ফরাসিরা চন্দননগরসহ  ঢাকা অঞ্চলে এবং ডেনিশরা বাংলায় নানা কৌশলে ঘাটি স্থাপনের মাধ্যমে বসতি গড়ে তুললেও   এ অঞ্চলকে পুরোপুরি উপনিবেশ বানাতে সমর্থ হয়নি। কিন্ত ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলা পরাজিত হলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সূচনায় ইংরেজরা বাংলা দখল করতে থাকে এবং বাংলা হতে থাকে তাদের উপনিবেশ। তার পর ১৯০ বছর তাদের শাসন স্থায়ী করতে পারলে ও ইংরেজরা বাংলা দেশের প্রতিবাদী মানুষকে ভয় করতো। বহু বেনিয়াকে  অনেক রক্ত ঝড়াতে হয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে।
ইংরেজদের আগে ও  যারা অন্যায়ভাবে  এ দেশে এসেছে তাদের কম প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়নি। মৌর্যরা এসেছিল মগধ বা বর্তমান ভারতের বিহার থেকে। তাদের আসার সময় বাংলার তৎকালীন জনপদ অঙ্গ ও বঙ্গের মত ছোট ছোট রাজ্য হতে প্রতিরোধ করা হয়েছিল। অনেক চেষ্টার পর সম্রাট অশোক বাংলা দখল করতে সমর্থ হন। অনুরূপ ভাবে গুপ্তরা ও এসেছিল মগধ থেকে। ওই সময় গুপ্তদের  কুচ রাজা ও স্থানীয় অন্যান্য রাজাদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিল। অনেক চেষ্টার পর সমুদ্র সুপ্ত বাংলার দখল নিতে সমর্থ হয়েছিলেন। কট্রোর পন্থী সেনেরা বাংলায় এসেছিল ভারতের দাক্ষিণাত্য থেকে। তখন ছিল পাল শাসন। পাল  শাসনের  প্রতিষ্ঠাতা গোপালকে বলা হয় স্থানীয় শাসক যিনি মূলত বাংলা থেকেই উঠে আসা রাজা ছিলেন। কৌশলে সেই পালদের পরাজিত করে সেনেরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। সেনদের বিরুদ্ধে পালদের অনুসারীগণ তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। উল্লেখ্য যে,মুসলিম বিজেতা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির কারণে সেনদের দ্রুত পতন ঘটে, যার ফলে‌ তারা বাংলায় যতেষ্ট সুখশান্তি ভোগ করতে পারে নি।
পাঠান ও সুলতানী শাসন প্রতিষ্টা করতে আসার সময় ও বাংলা হতে নানা কৌশলে তুমুল প্রতিবাদ করে প্রতিরোধ গড়ে তুলা হয়। তবে বাংলাদেশে মোঘল আগ্রাসনের প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল খুবই শক্ত ভাবে। বার ভূইঁয়ারা বিশেষ করে ঈশা খাঁ মারাত্মক প্রতিবাদী ছিলেন । যশোরের প্রতাপাদিত্য মোঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে গেরিলা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তখন বাংলায়  বসবাসের নামে থেকে যাওয়া মগ ও পর্তুগিজ জল দশ্যূরা ও  মোঘল শাসনের বিরোধিতা করেছিল। মোঘলেরা অনেক সময়েই  শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী  প্রেরণ করে বাংলায়  তাদের দখলদারিত্ব বজায় রাখতে চেষ্টা  করেছে যার রক্ত মাখা বহু ইতিহাস রয়েছে।
১৭৫৭ সালের পর ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ হতে প্রচুর বিদ্রোহ করা হয়। যার কোন কোনটি রক্তক্ষয়ী রুপ নেয়। যতদিন পর্যন্ত পাক ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন বিদ্যমান ছিল অন্যান্য যে কোন এলাকার চেয়ে বাংলাদেশের মানুষ  আন্দোলন সংগ্ৰাম করেছে অনেক অনেক বেশি। উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ও বিদ্রোহের মধ্যে ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, বিভিন্ন সময়ে  বাংলার কৃষক বিদ্রোহ, ,চুয়াড় বিদ্রোহ,নীল বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার সংগ্ৰাম,মাস্টার দার নেতৃত্বে  চট্রগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন, হাজং বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন সহ আরোও অনেক আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে  সৃষ্টি করা হয়েছে।
বাঙালি জাতির বীরত্বগাঁথা জানতেন বিশ্বের তামাম জাতি। জানতেন আলেকজান্ডার দ্যা গ্ৰেট, নেপোলিয়ন দ্যা গ্ৰেট। আর আকবর দ্যা গ্ৰেটতো এ জাতিকে আয়ত্বে আনতে অনেক ঘাম ঝড়িয়েছেন। তাঁর আমলের শ্রেষ্ঠ সেনাপতি মানসিংহকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল এ বাংলায় এসে।
বাঙালি জাতির বীরত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ও সাহসিকতার কারণে  বিদেশিরা শাসন করতে এসে  একান্ত চেষ্টা করে ও পুরোপুরি সফল হতে পারে নি। সব সময় তাদের ভীতসন্ত্রস্ত থাকতে হয়েছে। বেনিয়াদের অনেক রক্ত দিতে হয়েছে। মোট কথা ইংরেজদের ১৯০ বছর আর পাকিস্তানের ২৩ বছরের শোষণ শাসনের কথা বাদ দিলে অন্য কারোও সময়ে  বাংলাদেশ বিদেশিদের উপনিবেশ ছিল বলা যায় না। যদিও বহু সংগ্ৰাম ও আত্মত্যাগের পর বাংলার মানুষ  অনেক আশা নিয়ে ১৯৪৭ সালে  ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে  মুক্তির স্বাদ পেতে চেয়েছিল। তখন দেশকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হলে  বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে  অধিকাংশ  মুসলমান পাকিস্তানে থাকতে আশ্বস্ত হয়েছিলেন। আশা ছিল তাঁদের জীবন মানের উন্নতি হবে। সাধারণ ভাবে খেয়ে পরে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকবে। কিন্তু পাকিস্তানিদের দ্বিমুখী নীতির কারণে সকল আশা ব্যর্থ হয় । তাদের পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশের মানুষ আরোও নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ও অবহেলিত হতে থাকে। বাংলার সম্পদে পাকিস্তানের উন্নয়ন হলে ও বাঙালি হতে থাকে দিনের পর দিন বুবুক্ষ,আর কঙ্কালসার দেহের জাতি। হতে থাকে  সকল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তারা আমাদের  ভাষা সহ সবকিছু কেড়ে নিতে চেয়েছিল । এমন অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষের বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্ৰামের ধারাবাহিকতায়  আসে  বায়ান্ন, চুয়ান্ন, বাষট্টি,ছেষট্টি, ঊনসত্তর। আসে সত্তর আর মহাপ্লাবনের মত আসে  একাত্তর। বাঙালিদের যা কিছু তাই নিয়ে তাঁরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অবর্তীন হয়। নয় মাস যুদ্ধ করে ত্রিশ লাখ বীর বাঙালি জীবন উৎসর্গ করেন, শহীদ হন। লাখ লাখ মা বোনেরা সভ্রম হারান। অবশেষে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে   ১৯৭১ সালে আসে  বাংলাদেশের মানুষের বহুল আকাঙ্খিত স্বাধীনতা। এখন আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মানুষ। যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকবো। দেশ হবে অধিকতর শক্তিশালী এবং উন্নত। স্বাধীনতার মাসে সকল শহীদের পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।
লেখক প্রাবন্ধিক ও সাবেক শিক্ষা অফিসার
Facebook Comments Box

Posted ৪:২১ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫

dainikbanglarnabokantha.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

রূপা
(1611 বার পঠিত)
ছোটগল্প (দেনা)
(1108 বার পঠিত)
দূর দেশ
(992 বার পঠিত)
কচু শাক চুরি
(915 বার পঠিত)
কৃষ্ণ কলি
(900 বার পঠিত)

সম্পাদক

রুমাজ্জল হোসেন রুবেল

বাণিজ্যিক কার্যালয় :

১৪, পুরানা পল্টন, দারুস সালাম আর্কেড, ১১ম তলা, রুম নং-১১-এ, ঢাকা-১০০০।

ফোন: ০১৭১২৮৪৫১৭৬, ০১৬১২-৮৪৫১৮৬, ০২ ৪১০৫০৫৯৮

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

design and development by : webnewsdesign.com

nilüfer escort coin master free spins