| বুধবার, ১১ নভেম্বর ২০২০ | প্রিন্ট
ড. মুহাম্মাদ মোহন মিয়া : ইসলামী অর্থায়নের নানা পদ্ধতি নিয়ে ইসলামী বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন। বর্তমান সমাজের প্রয়োজনে অর্থায়নের পদ্ধতি সম্পর্কে জানা খুব জরুরি। সেবা খাতে অর্থায়নের একটি পদ্ধতি হলো জুআলা। ইবনে রুশদ জুআলার একটি চমৎকার সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘জুআলা হচ্ছে, কাজ পরিপূর্ণ করার শর্তে কোনো ব্যক্তিকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোনো কাজে নিযুক্ত করা। যদি সেই ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট কাজটি সম্পূর্ণরূপে সম্পাদন করে, তাহলে সে ঘোষিত বিনিময় পাবে। আর যদি কাজটি সম্পূর্ণভাবে সম্পাদন করতে না পারে, তাহলে সে বিনিময় বা পারিশ্রমিক হিসেবে কিছুই পাবে না এবং তার প্রচেষ্টা বৃথা যাবে।’
জুআলা শরিয়াহসম্মত হওয়ার দলিল : পবিত্র কোরআনে জুআলা বৈধ হওয়ার পরোক্ষ দলিল রয়েছে। কোরআনে ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনা উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘তারা বলল, আমরা বাদশাহের পানপাত্র হারিয়েছি এবং যে কেউ এটা এনে দেবে সে এক উটের বোঝা পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী পাবে এবং আমি তার নিশ্চয়তাদানকারী।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৭২)
বাদশাহর পানপাত্র নিয়ে আসার জন্য তারা উটের বোঝা পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী পারিশ্রমিক নির্ধারণ করেছিল। এভাবে চুক্তি করাকে জুআলা বলা হয়। পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের শরিয়তের বিধানাবলি অনুসরণ করা আমাদের জন্য বৈধ, যতক্ষণ তা রহিতকারী কোনো আয়াত বা দলিল না থাকে।
জুআলা চুক্তি বৈধ হওয়ার সমর্থনে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস আছে। কোনো এক গোত্রের লোকেরা সাহাবিদের একটি কাফেলার কাছে এলেন এবং তাদের গোত্রপতির রোগমুক্তির জন্য কিছু পাঠ করে ঝাড়-ফুঁক করার জন্য অনুরোধ জানালেন। এই কাজের জন্য তাদের পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হলো। সাহাবিরা সেভাবে কোরআন পাঠ করলেন। এতে ওই গোত্রপতি রোগমুক্ত হলেন। তখন তারা ঘোষিত পারিশ্রমিক গ্রহণ করলেন। তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ঘটনাটি জানালে তিনি তাদের কাজটি অনুমোদন করেন।
ইসলামী আইনজ্ঞদের দৃষ্টিতে জুআলা : মানুষের কাজকর্ম সহজীকরণে এবং কাঠিন্য দূরীকরণে প্রয়োজনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে বেশির ভাগ ইসলামী আইনজ্ঞ জুআলা বৈধ হওয়ার পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। ইসলামী ফিকহের পরিভাষায়, নির্দিষ্ট কাজের বিপরীতে নির্দিষ্ট অর্থ প্রদান করে তা সম্পাদন করাকে জুআলা বলা হয়। কাজের দায়িত্ব কোনো সময় জ্ঞাত ব্যক্তিকে আবার কোনো সময় অজ্ঞাত ব্যক্তিকেও প্রদান করা যায়। যিনি তার কাজটি করিয়ে নেওয়ার জন্য পারিশ্রমিক বা বিনিময় দেওয়ার ঘোষণা দেন তাঁকে ‘জায়িল’ এবং যিনি কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব নেন তাঁকে ‘মাজউল লাহু’ এবং পারিশ্রমিককে ‘জাআল’ বলা হয়। আর সংশ্লিষ্ট কাজটিকে ‘মাজয়ল’ বলা হয়।
প্রাচীনকালে জুআলার প্রয়োগ : প্রাচীনকালে নির্ধারিত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনের জন্য জুআলা পদ্ধতিতে চুক্তি করা হতো। সাধারণত কোনো হারানো জিনিস খুঁজে দেওয়ার জন্য, কোনো বাগানের দেয়াল নির্মাণ করার জন্য, পানির কূপ খনন করার জন্য, কারো সন্তানকে কোরআন হিফজ করিয়ে দেওয়ার জন্য, চিকিৎসার মাধ্যমে রোগমুক্ত করিয়ে দেওয়ার জন্য অথবা কোনো প্রতিযোগিতায় বিজয়ের জন্য জুআলা পদ্ধতির ব্যবহার ছিল। অর্থাৎ বলা হতো, কেউ অমুক কাজটি করে দিতে পারলে তাকে নির্দিষ্ট বিনিময় প্রদান করা হবে। এই চুক্তির উল্লেখযোগ্য দিক হলো, কাজটি সম্পাদন করতে না পারলে কোনো বিনিময়/পারিশ্রমিক/পুরস্কার সম্পূর্ণ বা আংশিক কিছুই দাবি করা যাবে না। এ জন্য জুআলার ক্ষেত্রে ‘মাজউল লাহু (কাজ সম্পাদনকারী)’-এর ঝুঁকি বেশি থাকে। অর্থাৎ কাজ সম্পাদন করে দিতে না পারলে বা ‘জায়িল’কে কাঙ্ক্ষিত ফল প্রদান করতে না পারলে কোনো পারিশ্রমিকই সে পাবে না। তবে এ ক্ষেত্রে কাজ করার ব্যাপারে যার পূর্ণ আত্মবিশ্বাস বা সফল অভিজ্ঞতা রয়েছে, সে-ই এ পদ্ধতিতে কাজ গ্রহণ করে থাকে। আমাদের দেশে প্রচলিত ঠিকা কাজ বা ঠিকাদারি ব্যবসা অনেকটা জুআলার অনুরূপ। ঠিকাদারির ক্ষেত্রেও কার্যাদেশদাতার চাহিদা মোতাবেক কাজ সম্পাদন করতে না পারলে বিল না পাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। আবহমানকাল থেকে মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে এ ধরনের চুক্তি করে আসছে। প্রকৃতপক্ষে কে সফলতার সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত কাজটি করতে পারবে, তা জানা না থাকার ক্ষেত্রে এ ধরনের চুক্তির প্রয়োজন হয়।
উল্লেখ্য, কাজ শুরু করে দেওয়ার পর ‘জায়িল’ চুক্তি থেকে সরে যেতে পারবে না। এমতাবস্থায় চুক্তি থেকে সরে গেলে বা চুক্তি ভঙ্গ করলে পূর্ণ পারিশ্রমিক ‘মাজউল লাহু’-কে প্রদান করতে হবে। আবার চুক্তি শুরু বা কার্যকর হওয়ার পর যদি ‘মাজউল লাহু’ কাজটি পরিত্যাগ করতে চায়, তাহলে সে কোনো পারিশ্রমিক দাবি করতে পারবে না। এমনকি তার চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার কারণে যদি ‘জায়িল’ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কেননা সে তখন কাজটি করার দায়িত্ব নেওয়ার কারণে এখন আর কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।
বর্তমান যুগে যে ক্ষেত্রগুলোতে জুআলা প্রয়োগ করা যেতে পারে তা হলো মেডিক্যাল, কৃষি ও বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা; পানি, পেট্রল ও বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ অনুসন্ধান; মার্কেটিং, ক্রয়-বিক্রয় ও কমিশন এজেন্টের কার্যাবলি; জমি আবাদ করা ও কৃষিকাজ করা; হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার ও অনাদায়ি ঋণ আদায়; নির্দিষ্ট সার্টিফিকেট অর্জন; দেশে অথবা বিদেশে নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোনো কাজ করা এবং কাউকে কাজে নিয়োগ।
লেখক : কো-অর্ডিনেটর, ইসলামী ব্যাংকিং কনভারশন প্রজেক্ট, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড
Posted ৭:২৮ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১১ নভেম্বর ২০২০
dainikbanglarnabokantha.com | Romazzal Hossain Robel
এ বিভাগের আরও খবর
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।