
জেলা প্রতিনিধি সিরাজগঞ্জ | শনিবার, ১২ নভেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট
শীতের রাতে কুয়াশা ও ঠান্ডা বাতাঁসে একটি গরম কাপড়ের অভাবে ফুটপাট, বস্তি
ও রেল স্টেশনে যখন কনকনে শীতে ছিন্নমুল্য অসহায় শিশু ও বৃদ্ধরা কাঁপতে
থাকেন, সেই অসহায় ও দুস্থ মানুষদের কাছে এখন শস্তা গার্মেন্টসের ফেলে
দেয়া ঝুট কাপড়ের কম্বলই পৌছে যাচ্ছে। সেই কম্বল তৈরি হচ্ছে সিরাজগঞ্জের
কাজিপুরে। শীতের শুরুতেই কম্বল তৈরীতে উপজেলার ৩০টি গ্রামে রাত-দিন কাজ
করে যাচ্ছেন কম্বল তৈরীর কারিগররা।
যমুনা নদীর ভাঙন কবলিত সিরাজগঞ্জের কাজিপুরের শিমুলদাইড় বাজার, ছালাভরা,
বরশীভাঙ্গা, সাতকয়া, কুনকুনিয়া, পাইকরতলী, গাড়াবেড়, মাইজবাড়ি, চালিতা
ডাঙ্গা, মেঘাই, শ্যামপুর, নয়াপাড়া, গাঁন্ধাইলসহ প্রায় ৩০টি গ্রামে
গার্মেন্টসের ঝুটে নানা রং বেরংয়ের বাহারি কম্বল তৈরী হচ্ছে। এই শিল্পের
সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত প্রায় ২৫ হাজার পরিবার। পা মেশিন ও ফ্লাডলক
মেশিন দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের তৈরী কম্বল জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের
বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে।
সরেজমিনে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে যমুনা নদীর ভাঙ্গা-গড়ার সংগ্রাম করতে করতে
বসতভিটা ও ফসলী জমিসহ সহয় সম্বল হারিয়ে নিঃশ্ব হয়ে পড়ে অনেকেই। তখনই
উপজেলার বড়শীভাঙ্গার সাইদুল হক নামের অর্ধশিক্ষিত এক ব্যক্তি বিকল্প
উপার্জনের পথ খুজতে চলে যান ঢাকার মিরপুরে। সেখানেই পরিচয় হয় এক ঝুট কাপড়
ব্যবসায়ীর সাথে। তার কথায় ঝুট কাপড় কিনে চলে আসেন বাড়িতে। সেই ঝুট কাপড়
সেলাই করে তৈরি করেন কম্বল। তৈরীকৃত কম্বল সাইকেলের পেছনে নিয়ে বিভিন্ন
গ্রামে গ্রামে বিক্রি শুরু করেন। কম্বল বিক্রির সেই টাকায় বদলাতে থাকে
সাইদুলের জীবন। তার দেখায় একই গ্রামের চাঁন মিয়া, হাজী জিয়াউল হক, মনির
হোসেনসহ প্রায় ৫ জন শুরু করে কম্বল তৈরীর ব্যবসা। সেই থেকেই কাজিপুর
উপজেলায় শুরু হয় কম্বল তৈরীর কাজ। তার পর থেকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি
ওই অঞ্চলের মানুষের।
একেকটি কম্বল তৈরিতে মজুরী বাবদ ২৫ থেকে ৩০ টাকা করে পেয়ে থাকেন
কারিগররা। আর ফ্লাডলক মেশিনে ৪ জন শ্রমিক প্রতিদিন ৮শ থেকে ৯শ পিস কম্বল
তৈরি করে থাকেন। মেয়েদের কম্বল তৈরিতে মজুরী কম হলেও গৃহস্থালীর কাজের
ফাঁকে শীত মৌসুমে পরিবারের ছেলে-মেয়ে ও পুত্রবধুসহ সকলেই মিলে মিশে কম্বল
সেলাইয়ে ব্যস্ত থাকেন। এর ফলে সহজেই পরিবারের সকলে মিলে শীত মৌসুমে
পুরুষের পাশাপাশী মেয়েরা সংসারে বাড়তি আয় করে থাকেন।
কাজিপুরের তৈরী কম্বল জেলার গন্ডি পেরিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিশেষ
করে শীতের প্রবণ এলাকা সমুহ নাটোর, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়,
ঠাকুরগাঁও, পাবনা, কুষ্টিয়া, নওগাঁ, লালমনির হাট, নীলফামারী, খুলনা,
ঝিনাইদহ, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যাপারী মহাজনরা এসে এই
কম্বল ক্রয় করে থাকেন।
বড়শীভাঙ্গা গ্রামের কম্বল তৈরির কারিগর খালেদা বেগম জানান, পরিবারে
স্বামীসহ ৪ সদস্য। ১ ছেলে ১ মেয়ে। মেয়ে স্থানীয় স্কুলে ৫ম শ্রেনীতে ও
ছেলে ৩য় শ্রেনীতে লেখা পড়া করে। নদী ভাঙ্গন এলাকায় পরিবারের পুরুষদের
হাতে তেমন কাজ কর্ম থাকে না। একারনে বছর জুড়ে সংসারে অভাব অনটন লেগেই
থাকে। শীত মৌসুম আসলে ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়ার পাশাপাশি মায়ের সেলাইয়ের কাজে
টুকরো কাপড় গুছিয়ে মাকে কম্বল তৈরিতে সহযোগিতা করে। এতে আমাদের হাতে
কম্বল তৈরির বাড়তি কাজ সৃষ্টি হওয়ায় অভাবকে আমরা দুর করতে সক্ষম হয়েছি।
খালেদার স্বামী ফ্লাডলক মেশিনের কারিগর মোতাহার হোসেন জানান, শিমুলদাইড়
বাজারে কম্বল তৈরির কাজ করেন। তিনি প্রতিদিন প্রায় ৮/৯শ টাকা আয় করে। এতে
তাদের সংসারের খরচ বাদে ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া করাতে তেমন বেগ পেতে হচ্ছে
না।
শুধু মোতাহার হোসেনেই নায়, এই গল্প কম্বল পল্লী শীতের এই মৌসুমের
সহ¯্রাধিক পরিবারের। অত্র এলাকায় ১৫ হাজার পা মেশীন ছাড়াও শিমুলদাইড়
বাজারে রয়েছে প্রায় ৩শ যন্ত্র চালিত ফ্লাডলক পাওয়ার মেশিন।
ফ্লাডলক পাওয়ার মেশিনের আরের কারিগর মজনু শেখ জানান, পাওয়ার মেশিনে
প্রতিদিন ৪ জন কারিগর কাজ করে থাকেন। গড়ে ৪ কারিগর মিলে একটি পাওয়ার
মেশিনের আওতায় ৮শ থেকে ৯শ পিচ কম্বল তৈরি করতে পারে। এক্ষেত্রে কারিগররা
একেক জন ৮/৯ শত টাকা আয় করে থাকেন।
শিমুলদাইড় বাজারের ঝুট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শরিফুল ইসলাম জানান, ১৯৯৪
সালে প্রথমে কাজিপুরে গার্মেন্টসের ঝুট কাপড় নিয়ে আসেন সাইদুল ইসলাম
নামের এক বড় ভাই। তখন থেকেই ঝুঁট কাপড় দিয়ে কম্বল তৈরি শুরু করে
স্থানীয়ভাবে বিক্রি করা হয়। বর্তমানে কম্বলের পাশাপাশি ছোট ছেলে মেদের
পোশাকসহ প্রায় ৫২টি পন্য এই এলাকায় তৈরি হচ্ছে। শীতের এই মৌসুমে
শিমুলদাইড় বাজার হতে ১৮ থেকে ২০ লক্ষ পিস কম্বল দেশের বিভিন্ন স্থানে
সরবরাহ হয়ে থাকে।
শিমুলদাইড় বাজার কমিটির সভাপতি মো. আবু তাহের জানান, এক সময় এই ব্যবসাটি
স্থানীয় পর্যায়ে হলেও সময়ের ব্যবধানে এর পরিধি বেড়ে দেশ ব্যাপী বিস্তার
লাভ করেছে। বর্তমানে স্থানীয় ব্যপারী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে
ঋনের ব্যবস্থা করা গেলে নদী ভাঙ্গন কবলিত মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার
অনেক উন্নতি হত।
চালিতাডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান মুকুল জানান, শীত মৌসুমে
শিমুলদাইড় বাজারে শত কোটি টাকার ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে। কিন্তু হাতের কাছে
ব্যাংক ব্যবস্থা না থাকায় দুর-দুরান্ত থেকে মহাজনদের টাকা লেনদেন নিয়ে
ঝাঁমেলা পোহাতে হয়। তাছাড়া এখানে রাস্তাগুলো খুবই খারাপ মানের হওয়ায়
যাতায়াতে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।
কাজিপুর উপজেলা চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান সিরাজী বলেন, কাজিপুরের কম্বল
তৈরির কাজ শুরু হওয়ায় অনেক বেকারত্ব দূর হয়েছে, স্থানীয় সংসদ সদস্যর সাথে
পরামর্শ করে ব্যবসাটির প্রসারলাভে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সহ-সভাপতি এমদাদুল হক এমদাদ বলেন, এই
শিল্পকে কেন্দ্র করে কাজীপুরে গড়ে উঠেছে কম্বলের বাজার। দামে কম আর উন্নত
মানের হওয়ায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা আসছেন কম্বল
কিনতে। প্রতিদিন প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকারও বেশি কম্বল ক্রয়-বিক্রয়
হচ্ছে । সরকার ও দেশের বিত্তবানরা ত্রাণের জন্য দেশের বাইরে থেকে কম্বল
আমদানি না করে এখান থেকে কিনলে আমাদের এই শিল্পটির আরো প্রসার হবে
Posted ১০:২৬ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১২ নভেম্বর ২০২২
dainikbanglarnabokantha.com | Romazzal Hossain Robel
এ বিভাগের আরও খবর
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।