শেরপুর প্রতিনিধি: | শনিবার, ১৩ জুলাই ২০২৪ | প্রিন্ট
শেরপুরের ঝিনাইগাতী সদর ইউনিয়নের পাইকুড়া এআরপি উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীর কাছে নিজ স্ত্রী হেরে যাওয়ার পর ইউপি চেয়ারম্যান শাহাদত হোসেনের নেতৃত্বে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে ঢুকে রেজুলেশন খাতা ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠেছে। এরপর ইতিমধ্যে দেড় সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও খাতা উদ্ধার করতে পারেনি উপজেলা প্রশাসন। উল্টো ফলাফল বাতিলের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ফলে বিজয়ী প্রার্থী আলমগীর হোসেন বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না। এদিকে চেয়ারম্যান শাহাদত হোসেন তার অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচনের ফলাফল বানচাল করতে নানাভাবে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার ক্ষমতার দাপটের কাছে স্থানীয় কর্মকর্তারাও অসহায় বলে জানান একাধিক কর্মকর্তা। শুধু তাই নয় খাতা ছিনতাইয়ের ঘটনায় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, প্রধান শিক্ষকসহ কেউ এখন পর্যন্ত ওই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করার সাহস পাচ্ছেননা। এদিকে অভিযোগ ওঠেছে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের ইশারাতেই খাতা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে বলেও অভিযোগ ওঠেছে।
জানাযায়, ঝিনাইগাতী সদর ইউনিয়নের পাইকুড়া এআরপি উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সদস্য নির্বাচনের পর ১ জুলাই নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। ঝিনাইগাতী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ সভায় সভাপতি নির্বাচন করা হয়। এতে প্রার্থী হন ঝিনাইগাতী সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগ নেতা শাহাদত হোসেনের স্ত্রী নিলুফা আক্তার ও স্থানীয় সমাজ সেবক মো. আলমগীর হোসেন। আকাধিক প্রার্থী হওয়ায় উপস্থিত নয় জন সদস্য গোপন ভোট প্রদান করেন। এতে ৫ ভোট পেয়ে আলমগীর হোসেন নির্বাচিত হন। ৪ ভোট পেয়ে পরাজিত হন চেয়ারম্যানের স্ত্রী নিলুফা আক্তার। পরে সদস্যদের উপস্থিতি স্বাক্ষরসহ নির্বাচনের রেজুলেশন লেখা হয় রেজুলেশন খাতায়। নির্বাচনে স্ত্রীর পরাজিত হওয়ার খবরে ক্ষিপ্ত হয়ে ও নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের উদ্দেশ্যে প্রধান শিক্ষকের যোগসাজশে চেয়ারম্যান শাহাদত হোসেন তার ফুপাত ভাই মুকুল মিয়াকে সাথে নিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে ঢুকে ওই রেজুলেশন খাতা ছিনিয়ে নিয়ে চলে যান।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, প্রধান শিক্ষক কেউই ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দায়ের করেনি বা খাতা উদ্ধারের জন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় বাধ্য হয়ে বিজয়ী প্রার্থী আলমগীর হোসেন ঝিনাইগাতী থানায় এবং ইউএনও বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। এরপর পেরিয়ে গেছে দেড় সপ্তাহ। কিন্তু রেজুলেশন খাতা ফেরত না দিয়ে স্থানীয় এমপি, উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ নানা স্থানে দেনদরবার ও নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন চেয়ারম্যান শাহাদত। অপরদিকে খাতা উদ্ধারে উপজেলা প্রশাসনও কোন উদ্যোগ নেয়নি। এ ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত করে প্রাথমিক সত্যতা পেয়েও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি উপজেলা নির্বাহী অফিসার। অভিযোগ রয়েছে, ওই বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ও একজন কর্মচারীর নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। ওই দুই জনের নিয়োগ বানিজ্য করার জন্যই নানা ষড়যন্ত্র চলছে। এ জন্য মোটা অংকের টাকাও লেনদেন হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ঝিনাইগাতী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ” আমার কার্যালয়ে পূর্বঘোষিত তারিখ ও সময় অনুযায়ী সভাপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমি রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করি। সভাপতি পদে সদস্যগণ দুইজনের নাম প্রস্তাব করায় কন্ঠ ভোটের সুযোগ ছিল না। ফলে আমি নয়জন সদস্যের হাতে ব্যালট বুঝিয়ে দিয়ে পাশের রুমে গোপনে ভোট দিতে বলি এবং তারা সেভাবেই ভোট প্রদান করেন। পরে সকলের সামনে ভোট গণনা করি। এতে আলমগীর হোসেন ৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। নিলুফা আক্তার পান ৪ ভোট। তখন কমিটির সদস্য সচিব প্রধান শিক্ষককে নির্বাচনী ফলাফলের রেজুলেশন লিখতে বলি। তিনি তার মৌলভী শিক্ষককে সাথে নিয়ে রেজুলেশন লিখা প্রায় শেষ করেছেন। ‘সভাপতি পদে নির্বাচনে আলমগীর হোসেন বিজয়ী হয়েছেন’ শুধু এই কথাটা লিখা বাকি আছে। এমন সময় চেয়ারম্যান সাহেব একজন লোককে সাথে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে জানাতে চান, নির্বাচন কি শেষ হয়েছে। আমি বললাম জি শেষ হয়েছে, এখন রেজুলেশন লিখা হচ্ছে। এসময় তারা খাতাটি নিয়ে নেন এবং চলে যান। এমন নজিরবিহীন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। বিষয়টি এমপি মহোদয় এবং ইউএনও সাহেব অবগত আছেন এবং তারাই দেখছেন। চেয়ারম্যান সাহেব একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আমি এ বিষয়ে কিছু করতে পারবোনা। এখন খাতা পেলেই আমি আলমগীর হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করে বাকি কাজ সম্পন্ন করতে পারি।”
ক্যামেরার সামনে কথা না বলার শর্তে তিনি আরও বলেন, “ইউএনও স্যার আমাকে নির্বাচন বন্ধ করতে বলেছিলেন। আমি বলেছি যে, স্যার নির্বাচন তো সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন রেজুলেশন লিখা হচ্ছে। এরই মধ্যে এই ঘটনা ঘটে গেল। শুনতে পাচ্ছি ইউএনও স্যার নাকি তদন্তের আদেশ দিয়েছেন। এটা নিয়ে তো তদন্তের কিছু নেই। এটা বিষয়টিকে বিলম্বিত করার একটা কৌশল। যা কিছু ঘটেছে তা আমার সামনেই ঘটেছে। এখন ইউএনও স্যার বা ওসি সাহেব চাইলে যেকোন মুহূর্তে খাতা উদ্ধার করতে পারেন। খাতা পেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়”।
এবিষয়ে চেয়ারম্যান শাহাদত হোসেন মুঠোফোনে খাতা নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, নির্বাচনে কন্ঠভোট না নিয়ে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে কেন করা হয়েছে? কন্ঠভোটে দিলে আমরা জয়ী হতাম।
নির্বাচনে অনিয়ম করায় আমি রেজুলেশন খাতা নিয়ে আমার কাছে রেখেছি।” আপনি তো স্কুলের খাতা নিয়ে নিজের কাছে রাখতে পারেন না। তাছাড়া অভিযোগ রয়েছে আপনি অফিস কক্ষে ঢুকে খাতা ছিনিয়ে নিয়েছেন। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি? একথা বলার সাথে সাথে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, “আপনি আমাকে প্রশ্ন করার কে? আপনি আমাকে ফোন করেছেন কেন? আমার ইউনিয়নের স্কুল আমি বুঝবো, আপনি প্রশ্ন করার কে? আপনার কাছে কে অভিযোগ করেছে। প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষা অফিসার কি আপনার কাছে অভিযোগ করেছে।” তখন তাকে বলা হয় যে বিজয়ী প্রার্থী আলমগীর হোসেন থানায় এবং ইউএনও সাহেব বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তখন ক্ষিপ্ত হয়ে চেয়ারম্যান শাহাদত বলেন আলমগীর এখানে কে। হ্যাঁ খাতা আমার কাছে আছে। এটা আমি আর অফিস বুঝব।
অপরদিকে নির্বাচন শেষ হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান শিক্ষক নূরুন্নবীসহ ২/৩ জন ব্যক্তির নামে একজন সদস্য অবৈধভাবে নির্বাচিত হয়েছেন বলে অভিযোগ করে নির্বাচন স্থগিত করার জন্য ইউএনও এবং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবরে আবেদন করে। বিষয়টি গত ৭ জুলাই তদন্ত করেন ঝিনাইগাতী উপজেলা শিক্ষা অফিসার ফারহানা পারভীন। এসময় অভিযোগকারীরা এ ধরনের অভিযোগের কথা অস্বীকার করেন দরখাস্তের সাক্ষর তাদের নয় বলে জানিয়েছেন। মূলত ওই অভিযোগের মিথ্যা কাহিনী নিয়ে তদন্তের নাটক চলছে বলে আলমগীরের অভিযোগ।
এ ব্যাপারে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয় খাতা পেয়েছেন কিনা। তিনি বলেন, আমি লিখিত জবাব দিয়েছি। তিনি আরও বলেন এ বিষয়ে এমপি সাহেব যা বলবেন তাই করবো। আমার কোন ক্ষমতা নেই।
ভোটে বিজয়ী প্রার্থী আলমগীর হোসেন বলেন, “সদস্যদের ভোটে আমি বিজয়ী হয়েছি। অফিস থেকে খাতা ছিনতাই করে নেয়ায় আমি কর্তৃপক্ষের পরামর্শে থানার এবং ইউএনও মহোদয়ের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছি। ঘটনাটি এমপি মহোদয় সম্পুর্ণ অবগত আছেন। দেড় সপ্তাহ হয়ে গেল আমি কোন প্রতিকার পাচ্ছিনা। আমি এই ঘটনার প্রতিকার চাই এবং বিজয়ী হিসেবে দায়িত্ব বুঝে পেতে চাই।”
এবিষয়ে জানতে চাইলে ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, “এব্যাপারেও তদন্ত কমিটি গঠন করে দিই। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন হাতে পেয়েছি। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।” খাতা উদ্ধারের জন্য কি ব্যবস্থা নিয়েছেন এই প্রশ্নেও তিনি এড়িয়ে যান।
এ ব্যাপারে (শ্রীবরদী-ঝিনাইগাতী) আসনের সংসদ সদস্য এডিএম শহিদুল ইসলাম বলেন, ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনকে ঘিরে একটা বিবদমান পরিস্থিতি চলছে ব্যাপারটা আমি জেনেছি। তবে ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে আমি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। নিয়মের বাইরে যাবার কারো সুযোগ নেই।
Posted ৪:২১ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১৩ জুলাই ২০২৪
dainikbanglarnabokantha.com | Romazzal Hossain Robel
এ বিভাগের আরও খবর
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।