শনিবার ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

>>

শহীদ আসাদ এর রক্তের পরিক্রমা

  |   মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২১   |   প্রিন্ট

শহীদ আসাদ এর রক্তের পরিক্রমা

নূরুদ্দীন দরজী: 
শুনেছি মাস্টার দা সূর্য সেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পর মাস্টার দার ভয়ে চট্টগ্রামে অবস্থান রত ব্রিটিশ বাহিনীর নেতারা অনেক দিন আত্মগোগন করে থাকতো। তারা দিনের বেলা লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু কিছু নিজেদের অস্তিত্বের জন্য তৎপর থাকার চেষ্টা করে রাতে মধ্য বঙ্গোপসাগরের গভীরে জাহাজে থাকতো প্রাণ বাঁচাতে। ঠিক তেমনি ১৯৬৯ সালে বাংলার সূর্য সন্তান শহীদ আসাদের আত্মদানের পর স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের তখত তাউস কেঁপে উঠে, পালাবার পথ খুঁজতে উম্মুখ ছিল। পাকিস্তানীদের মরণ বীণা বেজে উঠেছিল তাদের কুমানসিকতার অন্তরালে। মাস্টার দাকে যেদিন ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল সেদিন বাংলার আকাশে সূর্য উঠেনি। তেমনি আবার যেদিন হায়ানার দল আসাদকে বুকের মধ্যখানে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করলো সেদিনও বাংলার আকাশ বাতাস গুমোট হয়ে পড়েছিল। স্বাধীকার ও স্বাধীনতা আদায়ের জন্য সমগ্র বাংলাদেশ এক হয়েছিল। নিয়েছিলো দীপ্ত প্রতিশ্রুতি।
১৯৬৯ সনের ২০ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক আমানউল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান (শহীদ আসাদ) এর রক্তে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের অগ্নিস্রোাত প্রবাহিত হয়। একই সাথে ২৪ জানুয়ারি বাংলা মায়ের আদরের দুলাল মতিউর, মকবুল ও আলমগীরের রক্ত মিশে সৃষ্টি হয়েছিল রক্তের মহাকল্লোল। বেগবান হয়ে যায় আমাদের স্বাধীনতা আদায়ের পথ। কুখ্যাত ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলা দ্বারা বঙ্গবন্ধুকে তারা ফাঁসি দেওয়ার পাঁয়তারা ও কুমতলব করেছিল আসাদের রক্তরঞ্জিত কম্পন সে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ ও ধূলিসাৎ করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার প্রদীপ্ত শপথ নিয়েছিলো। সারা দেশে মিছিল, মহা জনমিছিল, আর মশাল মিছিলে ছেয়ে গিয়েছিল। প্রতিটি মিছিলে প্রক¤িপত শ্লোগান হয়েছিলÑ “জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো”। আইয়ুব শাহি নিপাত যাক, গুন্ডা শাহি ধ্বংস হোক। মিছিলে কারীদের চোখে মুখে ছিল আসাদের রক্তের বিনিময়ের প্রতিশোধ গ্রহণের বজ্র¯পৃহা। আসাদের রক্ত বৃথা যেতে দিবনা, শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দিবা। এমনি গগণবিদায়ী শ্লোগান ও জনরোষের মুখে কিছু দিনের মধ্যেই স্বৈরাচারী আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আইয়ুব খান নিজেকে রক্ষার্থে কোন পথ না পেয়ে আমাদের দেশে সামরিক শাসন জারি করে। রেখে যায় আরেক মদ্যপ ইয়াহিয়া খানকে। জেনারেল ইয়াহিয়া দোর্দন্ড প্রতাপ নিয়ে তাদের গদি ঠিক রাখতে বাঙালি নিধনের পথ বেছে নেয়।
পাকিস্তান নামক শাসন যন্ত্রটি ১৯৪৭ সাল থেকে বাংলাদেশে তাদের শোষণ পরিচালনা করতে থাকে। বাংলা ছিল তাদের অত্যাচার ও জুলুম নির্যাতনের প্রধান কেন্দ্র বিন্দু। দীর্ঘ ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণে জন্য দেশের মানুষ তখন অধির আগ্রহ ও আশার স্বপ্নে বিভোর ছিল। তারা পেতে চেয়েছিল অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বাধীন জীবন। কিন্তু ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানীরা বাঙালি জাতীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল। এ দেশীয় কিছু কুলাঙ্গার সন্তানদের সহায়তা তারা পেয়ে আসছিল। পাকিস্তানের সকল কুমতলব ছিন্ন করে বাঙালি জাতির মুক্তির ইতিহাসে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরব ছড়ানো উপখ্যান।আর ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের এক উজ্জ্বল ও প্রদৃপ্ত নায়ক আমাদের শহীদ আসাদ।
আসাদুজ্জামান আসাদ ১৯৪২ সালের ১০ জুন জন্ম গ্রহণ করেন নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামে। তাঁর সুযোগ্য পিতা শিবপুর তথা নরসিংদীর শ্রদ্ধেয়জন আলহাজ্ব মাওলানা মোহাম্মদ আবু তাহের বি,এ বি,টি। ঐতিহ্যে পূর্ণ হাতিরদিয়া সাদত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় সেখানে আসাদের জন্ম হয়। তাঁর মা মরহুমা মতি জাহান খাদিজা খাতুন ছিলেন শিক্ষিকা। মা নারায়ণগঞ্জে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। আসাদ ছোটকাল থেকেই নিপীড়িত মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন আনয়নে উদগ্রীব হয়ে পড়েছিলেন। কলেজে পড়ার সময় থেকেই ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে যান। পরে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বৃহত্তর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য তাঁর মন কাঁদতো। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি নিজ এলাকায় শিবপুরে কৃষক সংগঠন করে তোলেন। তাঁর নেতৃত্বে পরবর্তীতে শিবপুর, মনোহরদী, রায়পুরা ও নরসিংদী এলাকায় শক্ত কৃষক সংগঠন গড়ে উঠেছিল। তিনি এ এলাকার বহু সফল হরতালের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আমানউল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানকে (শহীদ আসাদ) স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘স্বাধীনতা পদক-২০১৮’ (মরনোত্তর) পদকে ভূষিত করা হয়।
দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষে ১১ দফা দাবীর কর্মসূচি নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তখন সারা বাংলায় ছড়িয়ে যায়। সমগ্র বাংলাদেশ এ দাবীর সমর্থনে ব্যাপক সাড়া দেয়। ১১ দফা কর্মসূচি প্রমথ আরম্ভ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র সমাবেশ আহবান করা হয়েছিল। তখন রাস্তায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। পরের দিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা রাস্তায় মিছিল করে করলে তাদের পুলিশ বাঁধা দেয় ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে।
১৯ জানুয়ারি আবার ও মিছিল বের হলে পুলিশ বাঁধা দেয় ও গুলি করে। এর পর দিন ২০ জানুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের হলে পুলিশ চানখারপুল এর মোড়ে অবস্থান নিয়ে তাদের জীপ থেকে বাংলা মায়ের দামাল ছেলে আসাদকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়লে আসাদ শাহাদাত বরণ করেন। আসাদ শহীদ হবার পর এ খবর দাবানলের মত সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। ঊনসত্তর রূপ পায় অগ্নি স্ফূলিঙের। সারা দেশ হয় উত্তাল।
পরের ইতিহাস সবাই জানেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হতে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু আসেন তাঁর প্রিয় মানুষের কাছে। চলে বিশাল ও উত্তাল সংগ্রাম। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করে তিনি পান অভূতপূর্ব হাড়া। বেইমান ও শোষণকারীরা বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হয়নি। বিভিন্ন ভাবে তাল বাহানা করে। অবশেষে আসে ২৫ মার্চ এর কালোরাত। শুরু হয় তাদের বাঙালি নিধনযজ্ঞ। আমাদের বিসর্জন করতে হয় ত্রিশ লক্ষ প্রাণ । নির্যাতিতা হয় প্রায় তিন লক্ষ মা বোন। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা পাই স্বাধীনতা। আসাদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে আজ আমাদের দেশ স্বাধীন। আমরা এখন সার্বভৌম জাতি। দেশরতœ শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্জন এখন বিশ্বের রোল মডেল। বঙ্গবন্ধুর সুমহান নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পেরেছি। আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আসছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ স্বাধীন করতে ও তার অর্জনে যারা তাদের তাজা জীবন উৎসর্গ করেছেন, শহীদ হয়েছেন তাদের ঋণ অপরিশোধ্য। আসাদের কথা লিখে শেষ করা যাবেনা। বাঙালি জাতির জন্য আসাদ উদয়ের রবি, অহংকার, দীপশিখা ও প্রদীপ্ত গর্ব। আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে জানতে হবে আসাদকে, বুঝতে হবে বাংলাদেশকে। খুঁজে নিতে হবে আসাদের অবদান। আসাদ শহীদ হয়েছেন অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে গেছে। হয়তো তাঁর ইতিহাস অতীত। আমাদের মনে রাখতে হবে বর্তমান দাঁড়িয়ে আছে অতীতের উপর ভিত্তি করে। ভবিষ্যৎ ও আসবে অতীতের স্মৃতি বুকে ধারণ করে। শহীদ আসাদ বুকের তরতাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে গেছেন এ বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য। বাঙালির ইতিহাস কোন দিনই আসাদকে ভুলতে পারবে না। শহীদ আসাদ সকল যুগের, সকল কালের ও শত সহস্র জনমের। শহীদ আসাদ আমাদের প্রেরণা।

লেখক: কলামিস্ট ও সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও)

Facebook Comments Box

Posted ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২১

dainikbanglarnabokantha.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক

রুমাজ্জল হোসেন রুবেল

বাণিজ্যিক কার্যালয় :

১৪, পুরানা পল্টন, দারুস সালাম আর্কেড, ১১ম তলা, রুম নং-১১-এ, ঢাকা-১০০০।

ফোন: ০১৭১২৮৪৫১৭৬, ০১৬১২-৮৪৫১৮৬, ০২ ৪১০৫০৫৯৮

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

design and development by : webnewsdesign.com

nilüfer escort coin master free spins