মিজানুর রহমান, শরীয়তপুর প্রতিনিধি | বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২২ | প্রিন্ট
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় একটি হিন্দু পরিবারকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছে সিকদার রিয়েল এস্টেট নামে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। উচ্ছেদের পর প্রভাবশালীরা বাগান বাড়ি তৈরি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন জায়গায় লিখিত অভিযোগ করেও কোন সুরাহা পায়নি ভুক্তভুগী পরিবার। পানি শরীয়তপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও সম্পদ উপ-মন্ত্রী একে এম এনামুল হক শামীম হিন্দু পরিবারটির ভাড়া বাসায় দেখতে যান। এ সময় তিনি ভিটেমাটি ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন। অপরদিকে উচ্ছেদের বিষয়টি অস্বীকার করছে সিকদার রিয়েল এস্টেট নামের ওই প্রতিষ্ঠানটির প্রকৌশলী।
হিন্দু পরিবারের সদস্য সুমিত্রা রানী, নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অবণী শংকর কর ও স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ডিঙ্গামানিক ইউনিয়নের মধুপুর গ্রামে অন্তত ৩০ একর জমির ওপর একটি বাগানবাড়ি গড়ে তুলেছেন প্রয়াত ব্যবসায়ী শিকদার গ্রæপের মালিক প্রয়াত জয়নুল হক সিকদার। ২০১৮ সালে বাড়ি থেকে জোর করে সুমিত্রা রানীর পরিবারকে উচ্ছেদ করে বাগান বাড়ি তৈরি করেছেন। উচ্ছেদ করার পর থেকে বসতভিটা ফিরে পেতে মানুষসহ প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওই পরিবারটি। ২০২০ সালে সুমিত্রা রানির ভাই জগদীশ ভিটেমাটি হারানোর পর বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকায় এবং বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ায় বড় ভাই পড়েশ চন্দ্র দে এর তিন কিশোরী কন্যা নিয়ে বিপাকে পরেন সুমিত্রা রানী। আশ্রয় নেন পাশের ডিঙ্গামানিক গ্রামের কাদির শেখের ভাড়া বাড়িতে। প্রাশসনেসর বিভিন্ন জায়গায় লিখিত অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পায়নি তারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পুকুরের মধ্যে আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন চারতলা আইল্যান্ড টাওয়ার নামে একটি আলিশান ভবন, পাশেই হরিণের খামার, দুটি পুকুরের সংযোগস্থলে সেতু আর নানা প্রজাতির গাছপালা দিয়ে সাজিয়েছেন বাগান বাড়িটি। এই বাগানবাড়িটি বানাতে গিয়েই হিন্দু পরিবারের সদস্য সুমিত্রা রানীর পরিবারকে জোর করে উচ্ছেদ করেছেন সিকদার রিয়েল এস্টেষ্ট নামের প্রতিষ্ঠান। অপরদিকে উচ্ছেদের বিষয়টি অস্বীকার করছে সিকদার রিয়েল এস্টেষ্ট নামের ওই প্রতিষ্ঠানটির এক প্রকৌশলী।
জানা যায়, প্রকৃতপক্ষে সুমিত্রা রানীর বাবা অমূল্য চরন দে ছিলেন ওই জমির মালিক। তার মৃত্যুর পর বিআরএস জরিপে সুমিত্রা দেবীর ভাই পড়েশ চন্দ্র দে ও জগদীস চন্দ্র দে’র নামে ওই জমির মালিকানা হয়।
২০০৯ সালে পড়েশ চন্দ্র দে তিন শিশুকন্যা রেখে মারা যান। এর তার স্ত্রী ঝর্না রানী এ তিন শিশু কন্যাকে রেছে অন্যান চলে যায়। এরপর সুমিত্রা ও তার ভাই জগদীশ দে পিতা মাতাহীন এই শিশুদের লালন পালনের দায়িত্ব নেন।
হিন্দু পরিবারের সদস্য সুমিত্রা রানী বলেন, আমাদের বাবদাদার ৪১ শতাংশ বাড়িসহ জমি জোর পূর্বক দখল করে নিয়ে যায় শিকদার গ্রæপ। আর সেখানেই নির্মাণ করা বাগান বাড়ী ও সীমানা প্রাচীর। এর পর আমাদেও সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, ‘এই শোকে আমার ভাইডাও মইরা গেল। একটা মেয়ে রুপা রানী দে সামান্য চাকরি করে যে বেতন পায় তা দিয়ে কোন রকম সংসার চলে। সুমিত্রা রানী জানান, নিজের বাড়ির ভিটায় ফিরে যাওয়া তাদের এখন স্বপ্ন।
রতন দে’র মেয়ে রুপা রানী দে বলেন, ‘সিকদারের ছেলেরা বাড়ি এলেই গোলাগুলি করত, আরও অনেক কাজ করত। ভয়ে আমরা বাড়ি থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে থাকতাম। মা-বাবা নাই, কাকাও মারা গেছে, এখন শুধু পিসিই বেঁচে আছেন। জমি আর আমাদের জন্য চিন্ত করতে করতে তার শরীরও ভালো নেই।’
রুপা রানী দে জানান, মহিলা অধিদপ্তরের একটা প্রজেক্টে কাজ করি। তাতে ৮ হাজার টাকা বেতন পান। তা দিয়ে ঘর ভাড়া, তিন বোনের পড়ার খরচ, পোশাক, খাওয়া কোনোটাই পুরোপুরি করা সম্ভব হয় না। সব সময়ই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগী আমরা। উপ-মন্ত্রী একে এম এনামুল হক শামীম তাদের একবার দেখতে গিয়েছিলেন। ভিটেমাটি ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে তিনি আশ্বাসও দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে সিকদার রিয়েল এস্টেষ্ট এর প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপক সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘সুমিত্রারা এখানে বসবাস করতেন। এখনও তাদের দুটি ঘর আছে। আমাদের নিরাপত্তার জন্যই বাউন্ডারি দেয়া হয়েছে। তাদের উচ্ছেদ করা হয়নি। তারা চলে গেছেন। তাদের যদি কোনো কাগজপত্র থাকে এবং সেটা যদি তারা দেখাতে পারেন তাহলে যেভাবে মীমাংসা করতে চান, সেভাবেই মীমাংসা করা হবে।’
জমির মালিকানা জানতে ঘড়িসার ইউনিয়ন ভূমি অফিসে গেলে ভূমি কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন মোল্লা বলেন, দাবি করা জমিটির মালিক হচ্ছেন অমূল্য চন্দ্র দের দুই ছেলে পড়েশ চন্দ্র দে ও ভাই জগদীস চন্দ্র দে। এই জমির খাজনা ২০১৭ সাল পর্যন্ত পরিশোধ করেছেন সুমিত্রা রানী দে।
ইড়িয়া উপজেলা সহকারী ভুমি কর্মকর্তা ( এসিলেন্ড) কাফি বিন- কবীর বলেন, আমি নতুন এখানে এসেছি। এ বিষয়ে আমি কিছু জানিনা। তবে বিষয়টি খোজ খবর নিয়ে দেখবো।
হিন্দু পরিবারকে বাড়ী থেকে উচ্ছেদের বিষয়টি স্বীকার করে নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ রাশেদুজ্জামান বলেন, শরীয়তপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও পানি সম্পদ উপ-মন্ত্রী একে এম এনামুল হক শামীম স্যার সুমিত্রা রানি দের পরিবারের খোজখবর নিতে তার বাড়ি গিয়েছিলেন। এবং মন্ত্রী তাদের আর্থিক সহায়তা করেছেন। আমরা উপজেলা প্রশাসন তাদেরকে খাবার ও কম্বল দিয়েছি। তাদের বাড়ী জায়গা উদ্ধার করাটা, প্রত্রিæয়ার ব্যাপার।
Posted ৪:১৮ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২২
dainikbanglarnabokantha.com | Romazzal Hossain Robel
এ বিভাগের আরও খবর
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।