দেশের বেশিরভাগ সিনেমা হল এখন বাণিজ্যিক ভবন বা শপিংমলে রূপান্তরিত হয়েছে। কারণ ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন। ফলে ইউটিউবে সার্চ দিলেই দেশি-বিদেশি নানা ধরনের মুভি দেখা যায়। আর এ কারণে দর্শক হারিয়ে সিনেমা হল বন্ধ করে দিচ্ছেন মালিকরা।
শিল্পী ও কলাকুশলীদের কষ্টের কারণ হলো, তারা আগের মতো কাজ পাচ্ছেন না। ফলে অনেকেই অর্থকষ্টে দিনযাপন করছেন। মাঝেমধ্যে পত্রিকায় দেখি একসময়ের পর্দা কাঁপানো কোনো কোনো শিল্পী এখন ফুল বিক্রেতা। কেউ কেউ বার্ধক্যে এসে চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারছেন না। অথচ এমন একটা সময় ছিল যখন নতুন সিনেমা মুক্তি পেলেই হলগুলো কানায় কানায় ভরে যেত। এখন যে কয়টি সিনেমা হল চালু রয়েছে তাতে কোনো ছবি মুক্তি পেলেও আগের মতো আর ভিড় দেখা যায় না। কেন এমন হলো? ৯০ এর দশকে ইলিয়াস কাঞ্চন-অঞ্জু ঘোষ অভিনিত ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ এ যাবৎকালের সবচেয়ে ব্যবসাসফল বাংলা সিনেমা। কিন্তু এখন কেন এরকম গল্প দিয়ে সিনেমা নির্মিত হচ্ছে না। এজন্য কি শুধুই ডিজিটাল প্রযুক্তির সহজলভ্যতা দায়ী? যদি মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায়, তাহলে দর্শক আবারও হলমুখী হবে। প্রেক্ষাগৃহে না যাক, ডিজিটাল মাধ্যমে তারা চলচ্চিত্র দেখলেও তো প্রযোজকদের আয়ের সুযোগ হবে। কারণ আমরা জানি বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল বা ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে কোনো ভিডিও যত বেশি সার্চ হবে, ওই ইউটিউবার ততবেশি আয় করেন।
কয়েক বছর আগেও সিনেমার গল্প থেকে শুরু করে সবকিছুতে শিল্পের ছোঁয়া থাকত। অন্যথায় দর্শক টানা যাবে না। অশম্লীল সিনেমা দিয়ে সাময়িক লাভ করা গেলেও সুদহৃরপ্রসারী শূণ্যতা তৈরি হয়। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ষ্টপ জেনোসাইড’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’, হুমায়ুন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর ‘গেরিলা’, মোরশেদুল ইসলামের ‘দীপু নাম্বার টু’ দর্শক মনে অভূতপহৃর্ব সাড়া ফেলে।
রাজ্জাক-কবরী, শাবানা-আলমগীর-ববিতা, শাবানা-জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চন-দিতি-অঞ্জু-চম্পা, ওমর সানি-মৌসুমী, সালমান শাহ-শাবনহৃর, নাঈম-শাবনাজ, ফেরদৗস-পহৃর্নিমা-রিয়াজ জুটি সফল হয়েছিল। শাকিব খান-অপু বিশ^াস যাত্রা শুরু করে ভালোই করছিল। কিন্তু এখন শাকিব-বুবলি সেটাকে ধরে রাখতে পারছে কিনা সে বিতর্কে যেতে চাই না। এ্যাকশন হিরো হিসেবে মান্না দর্শকদের কাছে আলাদা স্থান তৈরি করেছিল। এটিএম শামসুজ্জামান, হুমায়ুন ফরিদির মতো খলচরিত্র বাংলা সিনেমা পেয়েছে-এটা কম কথা নয়। মা চরিত্রে ডলি জহুর-আনোয়ারা-কল্পনা ও বাবার চরিত্রে প্রবীর মিত্র, আবুল হায়াৎ, আনোয়ার হোসেন দর্শকের হƒদয়ে গেঁথে আছেন। কমেডিতে দিলদার, টেলি সামাদ ও আফজাল শরীফ হাসির খোরাক জোগিয়েছে।
সাদা-কালোর যুগ পেড়িয়ে আমরা রঙিন সিনেমা নির্মাণ করছি। এত অর্জনের পরও কেন পেছনে পড়ে থাকতে হবে? একসময় সাদাকালো আর এনালগ প্রযুক্তিতে সিনেমা তৈরি করে যদি দর্শকমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলা যায়, তাহলে এই ডিজিটাল বাংলাদেশ অত্যধুনিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণে নির্মিত সিনেমা কেন দর্শক টানতে পারছে না। প্রায়ই অভিযোগ শুনতে হয়-ছবি মুক্তি পাওয়ার পর হলে দর্শক হয় না। স্টাফদের খরচ না ওঠারও অভিযোগ করে থাকেন অনেক হলের ম্যানেজার। অথচ ইলিয়াস কাঞ্চনের ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ কিংবা নায়ক রাজ রাজ্জাক অভিনিত ‘বাবা কেন চাকর’ এখনো কোন হলে চালালে দর্শক হবে। এর কারণ তারা গল্প ও অভিনয় দিয়ে দর্শকের হƒদয়ে জায়গা করে নিতে পেরেছেন।
পশ্চিমাদের পাশাপাশি ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা সিনেমা নকল করে আমাদের দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিযোগ পুরোনো নয়। অথচ রাজ্জাকের ‘বাবা কেন চাকর’ পশ্চিমবঙ্গে নির্মিত হয়েছে। সেখানে তারা আমাদের নায়ক রাজ রাজ্জাককে নিয়ে গেছেন বাবা চরিত্রে অভিনয় করতে। বাংলাদেশে যেমন পায়জামা-পাঞ্জাবী পড়ে রাজ্জাক নিজের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। তেমনি ভারতীয় সংস্কৃতিতে গিয়ে ধুতি পড়েও সমানে নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে এসেছেন এ গুনি নির্মাতা। আমাদের ফেরদৌস তো পশ্চিমবঙ্গে সিনেমাপ্রেমিদের কাছে খুবই পরিচিত মুখ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন হয়ে গেল। একসময়ের হৃপালী পর্দার আলোচিত নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন একঝাঁক গুনি শিল্পী। নবীন ও প্রবীণের সমন্বয়ে নির্বাচিত এ কমিটির কাছে আমাদের প্রত্যাশা আপনারা হারানো অতীত ফিরিয়ে আনুন। পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পী, কলা-কুশলী সবাইকে নিয়ে কাধে কাধ রেখে শিল্পের উন্নয়নে কাজ করুন। নানান মানুষ নানা মত থাকবে। এটাই গণতন্ত্রের অলংকার। সবাইকে নিয়ে কাজ করতে পারাটাই হলো আসল নেতৃত্বের পরিচয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, নির্বাচন ঘিরে শিল্পীদের মধ্যে নানা বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই দ্বন্দ্ব নির্বাচনের পর চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে। একের বিরুদ্ধে অন্যের অভিযোগ, বিষোদগারে সাধারণ মানুষ হতাশ ও রীতিমত বিরক্ত। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মন্তব্য বা কমেন্ড পরলেই সেটা বোঝা যায়। ইতিপূর্বে চলচ্চিত্র শিল্পীদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী এরকম অবস্থান কখনো তৈরী হয়নি। চলচ্চিত্র শিল্পীরা সমাজের সৃজনশীল মানুষ তাদের কাজ দেখে সাধারণ মানুষ দেশীয় কৃষ্টি -সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবেন এবং চলচ্চিত্রের মানুষদেরকে শ্রদ্ধা করবেন।
কিন্তু শিল্পীদের মধ্যে বর্তমানে বিদ্যমান দলাদলি, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, কাদাছুড়াছুড়ির ঘটনায় শিল্পীদের মর্যদা ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে আমরা মনে করি। কাজেই শিল্পীরা নিজেদের স্বার্থেই পারস্পরিক সৌহার্দতা, আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধাবোধ ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হবেন বলে আশা করছি। চলচ্চিত্র শিল্পকে বাচাতে হলে দর্শকদের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন ছবি বানাতে হবে। প্রত্যেক শিল্পীকে নিজের পেশাগত মানোন্নয়নসহ সিনেমার কাজে মনযোগী হতে হবে। শিল্পীরা বেচে থাকেন তাদের শিল্প কর্মে। ফলে শিল্পী সমিতিকে তাদের কাজের মানোন্নয়নসহ কাজের পরিধি বাড়াতে সচেষ্ট থাকতে হবে। শিল্পী সমিতির নির্বাচনের পর এফডিসিতে তৈরী হয়েছে অস্থিতিশীল পরিবেশ।
নির্বাচনে পক্ষপাতির অভিযোগে চলচ্চিত্রের সংশ্লিষ্ট ১৭ সংগঠন এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অপসারনের দাবি করেছে। সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী চিত্রনায়িকা নিপুণ, পরাজয় মেনে না নিয়ে ভোট কারচুপির অভিযোগ করেছেন। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী জায়েদ খানের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ নিয়ে প্রেস কনফারেন্স করেছেন। অভিনেত্রী নিপুণ বলেন, তার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে, তাকে কারচুপির মাধ্যমে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি এই অন্যায়ের শেষ দেখে ছারড়বেন। তিনি আরো বলেন, ‘চলচ্চিত্রের স্বার্থে আমি এবার নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। আমরা সাধারণ সম্পাদক পদে পুনরায় নির্বাচন চাই।’ ২৮ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট পরিচালক, প্রযোজকসহ ১৭ সংগঠনের কর্মকর্তা ও সদস্যদের এফডিসিতে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। ফলে তারা নির্বাচনের দিন এফডিসিতে ঢুকতে না পারায় বিক্ষোব্ধ হয়েছেন। অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পীসহ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকলকে সৌহার্দ্য ও স্থিতিশীল অবস্থায় আসা প্রয়োজন।
ইলিয়াস কাঞ্চন স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের সড়ক দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে আলাদা মাত্রা তৈরি করেছেন। সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করেছেন। আমি বিশ^াস করি তার হাতে চলচ্চিত্রের সোনালি অতীত ফিরে আসবেই।
চলচ্চিত্রের সোনালি অতীত ফিরিয়ে আনতে হলে তথা এফডিসিকে আবার ব্যস্ত করতে হলে মানসম্মত সিনেমা নির্মাণ করতে হবে। দর্শকের চাহিদা বুঝে যেমন সিনেমা নির্মাণ করতে হবে, তেমনি সিনেমা হল কাঠামোতেও পরবির্তন আনতে হবে। ঢাকা মহানগরীতে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ¯দ্বার সিনেপ্লেক্স তৈরি হয়েছে। যতদহৃর জানি, এসব প্রেক্ষাগৃহে পর্যাপ্ত দর্শক সমাগম হয়। তারা লোকসানে নেই, বরং লাভে আছে। একজন পরিচালক, শিল্পী বা চিত্রনাট্যকার হওয়া অত সহজ নয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে দেখা যায়, রাতারাতি কেউ কেউ বড় শিল্পী হতে চান। এভাবে করে কিছুদিন দাপটে থাকলেও সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে যেতে হয়। আমরা চাই চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদিন্তদের অনুসরণে শিল্পী ও কলাকুশলী তৈরি হোক, যাদের হাত ধরে আমাদের হারানো অতীত ফিরে আসবে।
লেখক পরিচিতি ঃ
লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল
(শিক্ষক, কলাম লেখক, সমাজসেবক ও সংগঠক)
সভাপতি, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি
যুগ্ম- মহাসচিব, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) কেন্দ্রীয় কমিটি
ফোন ঃ ০১৫৫২৬৩১১১৮, ০১৮৪২৬৩১১১৮