
নিজস্ব প্রতিবেদক: | শনিবার, ০১ জুন ২০২৪ | প্রিন্ট
প্রফেসর ড. শাহজাহান খান ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ভাইস চ্যান্সেলর, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা
মধ্যপ্রাচ্যের অতি দুর্ধর্ষ এক দেশ ইসরায়েল। শতাব্দীকাল ধরে মাতৃভূমি থেকে স্থানীয় আরব অধিবাসীদের উচ্ছেদে চরম আগ্রাসন চালাচ্ছে তারা ফিলিস্তিনে। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের ভূমি জবর দখল করে প্রাশ্চাত্যের প্রতক্ষ মদদে ইহুদিদের জন্য একটি স্থায়ী বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের আগে এবং পরে এ অঞ্চল থেকে লাখ লাখ মানুষকে বিতাড়িত করেছে তারা। ইসরায়েলের দৌরাত্ম ও আগ্রাসনে ফিলিস্তিনের আরব অধিবাসীরা নিজভূমিতে আজ পরবাসী, কার্যত বন্দি জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে লাখ লাখ আরব।
বর্তমান বিশ্বে ইসরায়েলের সামরিক আধিপত্য, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা আধিপত্য, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং কূটনৈতিক শক্তির খবর কারো অজানা নয়। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ আরব নেতা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা বিশ্বাস করে– ইসরায়েল একটি অপরাজেয় এবং ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা দেশ। তাই তারা তাদের সামরিক এবং কূটনৈতিক ক্রোধ এড়াতে জায়নবাদী রাষ্ট্রের সব নির্দেশ অনুসরণ করে। তারা মনে করে ইসরাইলের বিপক্ষে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। সম্প্রতি হামাস তাদের সেই বিশ্বাসের মর্মমূলে চরম আঘাত করেছে। স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবীতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন সংগ্রামরত ফিলিস্তিনি এ প্রতিরোধ বাহিনী কোন রাষ্ট্র এবং আনুষ্ঠানিক সেনাবাহিনী ছাড়াই নির্মম, নৃশংস এবং নৈতিকভাবে অযোগ্য ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) বিরুদ্ধে লড়াই করতে দাঁড়িয়েছে। বেশ কয়েক মাস ধরে হামাস প্রতিরোধ করছে ইসরায়েলি বর্বর বাহিনীকে। সর্বোচ্চ সাহস, ত্যাগ ও দৃঢ়তার সাথে তাদের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
কেন ইসরায়েল অপরাজেয়?
প্রতিবেশী আরব দেশগুলির সাথে ১৯৬৭ এবং ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলের বিজয় এই মিথ তৈরি করেছিল যে ইসরায়েল একটি অপরাজেয় শক্তি। তাদের সাথে কেউ পারবে না। কেউ নেই তাদের সামনে দাঁড়ানোর মতো।
১৯৬৭ সালে, ইসরাইল মিশর এবং সিরিয়ার বিমান বাহিনীকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে এবং ছয় দিনের মধ্যে জর্ডানীয় বাহিনীকে পরাজিত করে। ফলস্বরূপ, ইসরাইল গাজা উপত্যকা, সিনাই উপদ্বীপ, পশ্চিম তীর এবং জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। এটি ছিল ফিলিস্তিনি ভূমিতে তাদের অবৈধ দখলে ইসরায়েলের আক্রমণাত্মক সম্প্রসারণ অভিযানের পরবর্তী পর্যায়ের সূচনা।
১৯৭৩ সালের অক্টোবরে, মিশর এবং সিরিয়া সিনাই এবং গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলি বাহিনীর উপর সমন্বিত অতর্কিত আক্রমণ শুরু করে। ইসরায়েল শেষ পর্যন্ত আক্রমণ প্রতিহত করে এবং তিন সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করে। এতে ইসরায়েল ও তার মিত্রদের মনোবল তুঙ্গে উঠে যায়। যেহেতু ইসরায়েলের প্রতিবেশী আরব দেশগুলির মধ্যে কেউ আইডিএফের মুখোমুখি এক মাসও লড়াই করতে পারেনি, তারা বিশ্বাস করা শুরু করে ইসরায়েলের সাথে কেউ পারবে না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর, ফিলিস্তিনের ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের সময়, ক্রমবর্ধমান সংখ্যক বিদেশী ইহুদি বসতি স্থাপনকারী আদিবাসী ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করতে শুরু করে, ইহুদিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভূমিকা হিসাবে হাজার হাজার আরবকে তাদের পৈতৃক ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করে। ১৯৪৮ সালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ফিলিস্তিনি জনগণকে তাদের বাড়িঘর থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে। এ সময় তারা ৭ লাখেরও বেশি আরব মুসলিম ও খ্রিস্টানদের হত্যা ও বহিষ্কার করে। ফিলিস্তিনি আরবদের তাদের বাড়িঘর ও ভূমি থেকে জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেওয়া, নিয়মিত উচ্ছেদ এবং অধিকৃত অঞ্চলে বিদেশী ইহুদিদের অবৈধ বসতিস্থাপনের প্রক্রিয়াসহ সব ধরনের দখলদারিত্ব এখনো অব্যাহত রয়েছে।
কেন ইসরায়েল ধরা—ছোঁয়ার বাইরে?
২২ জুলাই ১৯৪৬ সালে ডানপন্থী জঙ্গী ইহুদিবাদী সন্ত্রাসীরা জেরুজালেমের কিং ডেভিড হোটেলের দক্ষিণ অংশে বোমা হামলা করে, যা ছিল ফিলিস্তিনে স্থাপিত ব্রিটিশ প্রশাসনের সদর দফতর। সেখানে ৯১ জন নিহত হয়, হতাহত হয় আরো বহু মানুষ। কিন্তু এর কোনো তদন্ত হয়নি, কোনো অভিযোগ করা হয়নি কারো বিরুদ্ধে। হামলাকারী সন্ত্রাসীরা রয়ে গেছে সবার আড়ালে— অজ্ঞাত ও শাস্তিহীন। এই ঘটনা ইসরায়েলকে নিয়ে যায় আরো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বিশ্ববাসী বোঝে, ইসরায়েলকে ধরার কেউ নেই। এখানেই শেষ নয়, ১৯৪৭ সালের ৮ জুন সিনাই উপদ্বীপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জাহাজ ‘লিবার্টি’ ইসরায়েলি বিমান এবং টর্পেডো বোট দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়। এতে নিহত হয় ৩৪ মার্কিন নৌসেনা। আহত হয় আরও ১৯১ জন। আশ্চর্যজনকভাবে, এবারও সবাই নীরব, নিশ্চুপ। কোনও পদক্ষেপ, কোনও পরিণতি, কোনও প্রতিক্রিয়া নেই আমেরিকাসহ কারো। এ হামলার জন্য দায়ি সন্ত্রাসীদের কখনো বিচারের আওতায় আনা হয়নি। ইহুদিবাদীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্য বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি, নেয়ও না কখনো। উল্টো তারা সর্বদা ইসরায়েলের সুনাম নিশ্চিত করে চলে। এই সব ঘটনা ইসরায়েলকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যায়।
এতদিন সবই ঠিক ছিল। কিন্তু হঠাৎ ইসরায়েলের এই ক্রমবর্ধমান দখলদারিত্ব, খুন ও আগ্রসনে বাগড়া বাধায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। বরাবর ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা তথাকথিত অপরাজেয় ইসরায়েলকে হঠাৎ সশস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে চরম এক আঘাত করে বসে হামাস। ইসরায়েলের সুপ্রশিক্ষিত গোয়েন্দাদের নাকের ডগার ওপর দিয়ে সংঘটিত হামাসের এ আক্রমণের পরে নড়েচড়ে বসে গোটা বিশ্ব। এতে ইসরায়েলেরও পিলে যে চমকে যায়, তা বলাই বাহুল্য। স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষা ও জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অর্জনের জন্য দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ইসরায়েরর রক্তচক্ষু পাত্তা না দিয়ে লড়াই এখনো চালু রেখেছে হামাস। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মর্মমূল নাড়িয়ে দেওয়া হামাসের এ আক্রমণ ‘অপরাজেয়, ধরা ছোঁয়ার বাইরে ইসরায়েল’ বলে যে মিথ চালু ছিল, তাতেও যেন বড়সড় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিলো। শুধু হামাস নয়, ইয়েমেনে হুথি, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরাকের অন্যান্য মিলিশিয়া গোষ্ঠীর সামরিক সমর্থন হামাসকে দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং ইসরায়েলের নিরলস ও বেপরোয়া আক্রম প্রতিহত করতে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে।
প্রকৃতপক্ষে, ৭ অক্টোবর ২০২৩ এ হামাসের বিস্ময়কর অভিযান — খোদ ইসরায়েলের অভ্যন্তরে, এবং গাজায় জিম্মি করা— ইসরায়েলের অপরাজেয় এবং অস্পর্শী হওয়ার খ্যাতিতে একটি বড় ধাক্কা দিয়েছে। এটাই হামাসের ‘সবচেয়ে বড় অপরাধ’। তাই ইসরায়েলি সরকারের কাছে হামাসের অস্তিত্বের কোনো অধিকার নেই। আশ্চর্যের কিছু নেই, ইসরায়েল হামাসকে ধ্বংস করতে এবং ফিলিস্তিনিদের থেকে গাজা মুক্ত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
কিন্তু ভয় পাওয়া পশুর মতো কোণে ঠেলে দেওয়া মানুষগুলোর কাছ থেকে আপনি কী আশা করেন, কোথাও দৌড়ানো বা লুকানোর জায়গা যাদের নেই, বধের জন্য যারা প্রস্তুত! তারা কি ঘুরে দাঁড়াবে না আত্মরক্ষার জন্য? হামাসও ঠিক তাই করছে। অনেক নেতৃস্থানীয় ন্যায্য এবং নিরপেক্ষ সামরিক বিশ্লেষকদের কাছে, হামাস ইতিমধ্যেই বিজয়ী হয়েছে একটি অপ্রত্যাশিত ও অতর্কিত আক্রমণের কারণে। কিন্তু তাদের এ আক্রমণের জবাবে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী যে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে তা নজিরবিহীন। তারা নির্বিচারে কার্পেট বোমা মারছে এবং অকারণে অবকাঠামো ধ্বংস করছে, বেসামরিক বাসস্থান, হাসপাতাল, স্কুল, উপাসনালয় সব ধ্বসিয়ে সমতল করে দিচ্ছে। গাজা এবং পশ্চিম তীরে জাতিসংঘের অফিস, সাংবাদিক, উদ্ধারকারী কেউ বাদ যাচ্ছে না তাদের লক্ষবস্তু থেকে। ইসরায়েল যেন পোড়া মাটির নীতি গ্রহণ করেছে। ফিলিস্তিনি জনগণ, তাদের সংস্কৃতি, ভাষা এবং ইতিহাসের উপাদান সব সম্পূর্ণ ধ্বংস করে হলেও ফিলিস্তিনের ভূমি তাদের চাই! ইসরায়েলি বর্বরতা ও সহিংসতা গোপন রাখতে তারা এ পর্যন্ত ১৫৪ জন সাংবাদিক হত্যা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র কি ইসরায়েল সম্পর্কে তার নীতি পরিবর্তন করেছে?
ইসরায়েল রাষ্ট্রের সূচনার আগে থেকেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের একটি কট্টর সমর্থক। প্রকৃতপক্ষে তারাই ইসরায়েলের অবিচল রক্ষক এবং উকিল। ইসরায়েলের একজন অত্যন্ত বিশ্বস্ত অংশীদার হিসাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও সীমাহীন তহবিল, অস্ত্র এবং প্রযুক্তি দিয়ে ইসরায়েলকে সমর্থন করছে। অথচ তারা খুব ভালভাবে জানে যে ওউঋ হামাস জঙ্গিদের লুকিয়ে রাখার খোড়া অজুহাতে ফিলিস্তিনের সর্বত্র বেসামরিক লোকদের নির্বিচারে হত্যা করছে — একটি খুব পুরানো সুপরিচিত ইসরায়েলি প্রচার কৌশল। মার্কিন—ইসরায়েল অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল একই দিনে যখন ইসরায়েল ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল রান্নাঘরে বোমা হামলা করে সাত পশ্চিমা সাহায্য কর্মীকে হত্যা করেছিল, যারা গাজার ক্ষুধার্ত শিশু ও মহিলাদের খাদ্য দিয়ে সাহায্য করছিলেন। নির্মমভাবে নিহতদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান জোমি ফ্রাঙ্ককম ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ান সরকার বিমান হামলার পূর্ণ তদন্তের জন্য ইসরাইলকে বলেছে; কিন্তু সেই তদন্তের ভাগ্যে সীমাহীন নীরবতা ছাড়া আর কিছুই জোটেনি!
অধিকৃত অঞ্চলের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হচ্ছে যে, খোদ মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স বলেছেন, ইসরায়েলকে দেওয়া মার্কিন ট্যাক্স ডলার মূলত (ফিলিস্তিনিদের) গণ—দুর্ভোগকে অর্থায়ন করছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, গত ছয় মাসে গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান ফিলিস্তিনিদের জন্য “নিরলস মৃত্যু ও ধ্বংস” নিয়ে এসেছে। মার্কিন সরকার যদি মাটিতে থাকা তথ্য এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনগুলিকে সাবধানতার সাথে পর্যালোচনা করে তবে ইসরাইল কী করছে তা অবশ্যই দেখতে হবে এবং সিরিয়াল অন্যায়কারীদের জন্য তার দীর্ঘমেয়াদী অন্ধ এবং শর্তহীন সমর্থন পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং অরক্ষিত শিশু ও মহিলাদের হত্যা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। .
অতি—ডানপন্থী ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী, জনাব বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু একটি জাতিকে ধ্বংস করার মিশনে আইডিএফ মোতায়েন করেছেন, যার ফল ভোগ করছে গাজা এবং ফিলিস্তিনের অন্যান্য অংশের সকল মানুষ। গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার একটি যুক্তিসঙ্গত দক্ষিণ আফ্রিকার করা মামলায় জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) অন্তর্বর্তীকালীন রেজুলেশন সত্ত্বেও, আইডিএফ ফিলিস্তিন ও গাজায় গণহত্যা ও ধ্বংস অব্যাহত রাখতে বাধাহীন এবং নিরবচ্ছিন্ন অভিযান চালাচ্ছে। লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুভিটা ছাড়া করে জায়নবাদীদের জন্য ছুটির রিসর্ট তৈরি করার জন্য জমি দখল করছে।
ইসরায়েল কর্তৃক জাতিসংঘের সকল রেজুলেশন লঙ্ঘনের খবর ক্রমাগত প্রকাশিত হলেও ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের জন্য মানবিক সাহায্য সরবরাহে ইসরায়েলি অবরোধের ফলে গাজায় (এমনকি রমজান মাসেও) ব্যাপক ক্ষুধা ও অনাহার সৃষ্টি হয়। তৈরি হয় চরম মানবিক বিপর্যয়। তবুও গলেনি বরফ। ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নিন্দা শুরু হলেও পরিবর্তন হয়নি আমেরিকার অবস্থান। তবে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ স্বত্ত্বেও, জাতিসংঘের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২৫মার্চ, ২০২৪ তারিখ সোমবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব বন্ধ করতে ইসরায়েলের পক্ষে তার ভেটো ক্ষমতা যথাযথভাবে ব্যবহার করেনি।
রেজোলিউশনে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের নিঃশর্ত মুক্তি এবং গাজায় সাহায্যের “জরুরি প্রবাহ প্রসারিত করার” দাবি করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিরত থাকার পক্ষে ১৪টি দিয়েছিল। কিন্তু, যথারীতি, ইসরায়েল পাত্তা দেয় নি এবং জাতিসংঘের সর্বশেষ প্রস্তাব বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ দেখায়নি। অনেকেই এটাকে আমেরিকার লোক দেখানো নাটক মনে করেন। কারণ, প্রায় একই সময়ে (ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী), হোয়াইট হাউস ইসরায়েলের কাছে 1800 MK84, 2000—পাউন্ড (900KG ) বোমা এবং 500 MK82, 500—পাউন্ড (225KG) সহ একটি অস্ত্র সরবরাহ চুক্তি অনুমোদন করে। অনেক মার্কিন করদাতারা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসরায়েলের বার্ষিক $3.8 বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওয়ার কারণ নিয়ে প্রশ্ন করছেন; তারা ভাবছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের সহযোগী এবং ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার সাথে জড়িত কিনা। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জাতিসংঘকে একেবারে দন্তহীন এবং অসহায় বলে মনে হচ্ছে।
ইসরায়েল ততদিন অপরাজেয় থাকবে যতদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা ইসরায়েলের গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখবে এবং অর্থ, অস্ত্র, প্রযুক্তি এবং সামরিক বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তাদের সামরিক আগ্রাসনকে সমর্থন করতে থাকবে এবং একই সময়ে অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে মানবিক সরবরাহ এবং সাহায্য বিতরণে প্রতিবন্ধকতাকে সমর্থন করতে থাকবে। কিন্তু হামাস ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে ইসরাইল আর অস্পর্শী নয়। চাইলেই ইসরায়েলের দৌরত্মের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়া সম্ভব। এবং হামাস তা করে দেখিয়েছে।
ইসরায়েলের জন্য চূড়ান্ত সমাধান
সুতরাং, এটি কোন গোপন বিষয় নয়, শুধু হামাস বা ফিলিস্তিন নয়— কাউকেই পাত্তা দেয় না ইসরায়েল। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপও যদি তাদের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে বিশেষত প্রতিটি জীবিত ফিলিস্তিনিকে নির্মূল বা তাড়িয়ে দেওয়ার প্রশ্নে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, তাদেরকেও পাত্তা দেয় না ইসরায়েল। গাজা এবং পশ্চিম তীর দখল শুধু নয়; তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল পৃথিবীর মুখ থেকে ফিলিস্তিন জাতির ডিএনএ মুছে ফেলা। বিশ্বাস করুন বা না করুন, তারা শুধু সেখানে থামবে না, এটি কেবল তাদের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য। ইসরায়েলের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হল সমগ্র আরব উপদ্বীপ জুড়ে বর্ণবাদী ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলকে বিস্তৃত করা। ইসরায়েল দাবি করে যে তারা গাজায় হামাসের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। যদি তাই হয়, তবে কেন তারা পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর বোমা বর্ষণ করছে? কেন তারা হামাসের সাথে যুদ্ধ করার সময় জোরপূর্বক এবং অবৈধভাবে আরও ফিলিস্তিনি জমি দখল করে পশ্চিম তীরে বসতি বাড়াচ্ছে? হামাসকে নিয়ন্ত্রণ তাদের একটা অযুহাত মাত্র। তাদের মূল উদ্দেশ্য গোটা ফিলিস্তিন দখল। ক্রমান্বয়ে গোটা আরব!
২০২৩ সালের নভেম্বরের শুরুতে, তৎকালীন ইসরায়েলের ঐতিহ্য বিষয়ক মন্ত্রী, আমিচায় ইলিয়াহু বলেছিলেন যে গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলা এবং সেখানে সবাইকে হত্যা করা হামাসের হুমকি মোকাবেলার “একটি উপায়” ছিল। ২৫ মার্চ২০২৪ এ মার্কিন কংগ্রেসম্যান টিম ওয়ালবার্গ আবার গাজায় পারমাণবিক বোমা হামলার পরামর্শ দেন, যেমন ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জাপানের “হিরোশিমা এবং নাগাসাকি” বোমা হামলায় ১ লাখ ২৯ হাজার থেকে ২ লাখ ২৬ হাজার লোক মারা গিয়েছিল। এটি বিশ্বের কাছে কী সংকেত দেয়?
ইসরায়েল এবং অন্যত্র অনেক ইহুদিবাদীদের কাছে, ফিলিস্তিন—ইসরায়েল সংঘাতের চূড়ান্ত সমাধান হল সমস্ত ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা এবং বিদেশী ইহুদিদের দ্বারা অবৈধ বসতি স্থাপনের জন্য ফিলিস্তিনি ভূমি পরিষ্কার করা। বিশ্ব জানে যে ইসরায়েল সর্বদা একটি ইহুদি রাষ্ট্র, একটি ধর্মতান্ত্রিক ধর্মীয় রাষ্ট্র বলে নিজেদের দাবি করে। তাই এটি কখনোই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয় যা সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের জন্য সমান অধিকারের অনুমতি দেয়। ইহুদীবাদী এ রাষ্ট্রের কাজেই হলো ভিন্নধর্মের সকল মানুষকে বিতাড়িত করে, প্রয়োজনে পশুর মতো হত্যা করে নিজস্ব ইহুদীভূমি প্রতিষ্ঠা করা। বর্তমানের উদার গণতান্ত্রিক বিশ্বের পক্ষে যা মেনে নেওয়া কখনোই সম্ভব নয়।
আরব শান্তিরক্ষা বাহিনীর জন্য প্রস্তাব
ফিলিস্তিনিদের তাদের স্বাধীনতা ও স্ব—নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের অংশ হিসেবে, ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করছে আরব রাষ্ট্রগুলোকে বুঝিয়ে তাদের পক্ষে আনার জন্য। তারা একটি আরব শান্তিরক্ষা বাহিনী গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে এমন ভূখন্ডে, যে ভূখন্ডে গত শতাব্দীকাল ধরেই শান্তি নেই। তাদের প্রস্তাবটি হল যে, শান্তিরক্ষীরা ইসরায়েলের প্রক্সি হিসাবে ফিলিস্তিনিদের বিষয়গুলো পরিচালনা ও দেখাশোনা করবে। এটি মূলত ইসরায়েলের আরেকটি কৌশল। এর মাধ্যমে তারা মূলত কালক্ষেপন করতে চায়, ধীরে ধীরে ইসরায়েলি রাষ্ট্র সম্প্রসারণের সময় চায় এবং এর ফাঁকে হামাসকে ভেঙে দিয়ে নিঃচিহ্ন করতে চায় ফিলিস্তিনিদের। যদিও আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন উভয় জাতির পাশাপাশি শান্তিতে বসবাসের জন্য দ্বি—রাষ্ট্রীয় সমাধানের পক্ষে, কিন্তু ইসরাইল ফিলিস্তিন নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের বিপক্ষে। কোনোভাবেই তারা ফিলিস্তিন নামের কোনো দেশের অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায় না। তাদের প্রস্তাবিত যেকোনো শান্তি চুক্তিতে সব ফিলিস্তিনিকে নিরস্ত্র করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে; ইসরায়েলিদেরকে নিরস্ত্রিকরণের ব্যাপারে কিছু বলা নেই। ইসরাইলকে নিরস্ত্র না করলে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কেন নিরস্ত্র হবে? গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ইসরায়েলি ওউঋ—এর ভয়ানক অতীত কর্মকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলা যায় যে, ফিলিস্তিনে কোনো শান্তির কথা বলার আগে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে নিরস্ত্র করতে হবে। নইলে ফল কী হবে, তার উদাহরণ দেখা যায় বসনিয়ায়। ১৯৫৫ সালে জেনারেল ফিলিপ মরলিন এবং তার সৈন্যদের তত্বাবধানে ৮ হাজার নিরস্ত্র বসনিয়ান বেসামরিক মুসলমানের ওপর যে গণহত্যা চালানো হয়, তা নজিরবিহীন। ইসরায়েলিদের হাতে অস্ত্র রেখে শান্তি প্রস্তাবের নামে শুধু ফিলিস্তিনিদের নিরস্ত্র করলে, এখানকার ফলাফলও তেমন হওয়ার আশঙ্কা ব্যাপক।
ফিলিস্তিন পৃথিবীর বহু পুরনো একটি দেশ। এদেশের মুসলিমরা এক সময়ের সমৃদ্ধ জাতি। ইতিহাসে ফিলিস্তিনিদের সমৃদ্ধ অতীতের কথা এখনো লেখা আছে। এখানকার লোকেরা তাদের বিষয়গুলো নিজেরাই পরিচালনা করতে সক্ষম। নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অধিকার ও ক্ষমতা তাদের আছে। তারা চায় না অন্য কেউ তাদের নিয়ন্ত্রণ করুক। স্বাধীন ও মুক্ত ফিলিস্তিনের জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে কে তাদের দেশ চালাবে। ২০০৬ সালে, ফিলিস্তিনি আইন পরিষদের একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত, ইসরায়েল এবং তার মিত্র তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলো বিজয়ী দল হামাসকে ফিলিস্তিন শাসন করতে দেয়নি। স্বাধীন ফিলিস্তিনের জন্য জাতিসংঘ পরিচালিত একটি অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন প্রয়োজন, যেখানে তাদের জনগণ তাদেরকে পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। কোনো বহির্শক্তির চাপিয়ে দেওয়া শাসক বা পুতুল সরকার এখানকার জনগণের দুর্ভোগকে কেবল জটিল এবং দীর্ঘায়িত করবে, মানুষের মুক্তি মিলবে না। ফিলিস্তিনের মানুষের মুক্তির জন্য স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।
অকুতোভয় হামাস
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অবৈধ দখলদারিত্বের অধীনে তাদের জনগণের চলমান এবং দীর্ঘায়িত দুর্ভোগ দেখেছে হামাস। চরম বৈষম্য, অপব্যবহার, মারধর, তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ, তাদের জমি বাজেয়াপ্ত করা এবং বিতাড়ন, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ — এবং সর্বোপরি, ইস্রায়েলের বর্ণবাদী রাষ্ট্র দ্বারা অমানবিক আচরণ — এবং আরব শাসকদের সম্পূর্ণ অবহেলা তারা প্রত্যক্ষ করছে বছরের পর বছর। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পশ্চিমা শক্তির সহায়তায় ইসরায়েল তাদের বুঝিয়েছে যে, তাদের জীবন ছাড়া আর কিছুই হারানোর নেই। কাজেই হামাসের সামনে ইসরায়েলি বর্বরতা, সীমাহীন অপমান, অসহনীয় নিপীড়ন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতার মুখে সামর্থ্যপূর্ণ আক্রমণাত্মক লড়াই করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। পরিস্থিতিই তাদের হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য করেছে। তাদের জাতি রাষ্ট্র পুনরুদ্ধার এবং নিজেদের মর্যাদা রক্ষার জন্য শেষ অবলম্বন হিসেবে অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়েছে তারা।
আশ্চর্যজনকভাবে, অনেক অমুসলিম এবং অ—আরবরা ছোট প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাসের শক্তি, বীরত্ব এবং দৃঢ়তা দেখে বিস্মিত। কারণ এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপ্রাপ্ত বিশ্বের সবচেয়ে পরিশীলিত এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করে। পরাশক্তির দেশের অনেক যুবক তাদের অটল বিশ্বাস এবং দৃঢ় প্রত্যয়ে হামাসের আসল শক্তি আবিষ্কার করেছে যা তাদের মৃত্যুর ভয়কে জয় করতে সক্ষম করেছে। মজার বিষয় হল, পাশ্চাত্যের অনেক যুবক, যার মধ্যে বিপুল সংখ্যক ইহুদিও রয়েছে, এমনকি ডেভিড এবং গলিয়াথ যুদ্ধে হামাসের বীরত্বের আসল কারণটি খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ এবং আবিষ্কার করার পরে ইসলামে ফিরে এসেছে। যে জাতি তার অস্তিত্বের লড়াইয়ে মরতে বদ্ধপরিকর, তাদের পরাজিত করার কেউ নেই এই পৃথিবীতে। তাদের স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষা ভবিষ্যত প্রজন্মের আশাকে পুনরুজ্জীবিত করবে, এমনকি তারা যে বাহিনীর সাথে লড়াই করে তাদের হাতে নিহত হলেও। যে বিপ্লবের পথে হাঁটছে হামাস, সময় লাগলেও বিজয় নেশা কখনো তাদের হতাশ করবে না।
অস্বীকৃতি: এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামতগুলি একচেটিয়াভাবে লেখকের এবং কোনওভাবেই তার কোনও অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের প্রতিফলন করে না।
Posted ৫:৪৯ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০১ জুন ২০২৪
dainikbanglarnabokantha.com | Romazzal Hossain Robel
এ বিভাগের আরও খবর
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।