অনলাইন ডেস্ক | বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর ২০২০ | পড়া হয়েছে 292 বার
নিজস্ব প্রতিবেদক : নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধর করার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বরখাস্ত কাউন্সিলর ইরফান সেলিম ও তাঁর দেহরক্ষী জাহিদকে তিন দিন করে রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল বুধবার ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান নূরের আদালত এ আদেশ দেন। অন্যদিকে তাঁদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে পৃথক দুটি করে মোট চারটি মামলা তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে রাজধানীর ধানমণ্ডি থানায় দায়ের করা মামলা তদন্তের দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তদন্ত বিভাগে (ডিবি)।
পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল পৌনে ১০টায় কারাগার থেকে দুই আসামি ইরফান ও জাহিদকে আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় তাঁদের কারাগারের গারদে রাখা হয়। দুপুর ১২টায় ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান নূরের আদালত দুই আসামিকে ধানমণ্ডি থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখান। এরপর একই আদালতে দুই আসামির রিমান্ড শুনানি হয়। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী রিমান্ডে না দেওয়ার আবেদন করেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত প্রত্যেকের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গত মঙ্গলবার ধানমণ্ডি থানার পরিদর্শক (মামলার তদন্ত কর্মকর্তা) আশফাক রাজীব হায়দার আসামি ইরফান সেলিম ও জাহিদকে গ্রেপ্তার দেখানোসহ সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেছিলেন। আদালত আসামিদের উপস্থিতিতে গ্রেপ্তার দেখানোর বিষয়ে শুনানির জন্য গতকাল দিন ধার্য করেন।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আবু বলেন, আসামিরা নিরীহ ব্যক্তিকে কেন এভাবে মারধর করলেন। তাঁদের রিমান্ডে নিলে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে। এ ছাড়া মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিও আছে। তাদের পরিচয় জানতেও দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার।
আসামিদের পক্ষে আইনজীবী প্রাণনাথ রিমান্ডের বিরোধিতা করে বলেন, ‘ইরফান যে বাদীকে মেরেছেন এমন কথা এজাহারে বলা নাই। কে না কে মেরেছে, সেটা সুনির্দিষ্ট না।’ তিনি আরো যোগ করেন, ‘বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁর বাসায় গেল। সব দেখে তাঁকে গ্রেপ্তার করল, সাজাও দিল, যা কিছু আছে, যা নাই তাসহ সাজা হলো। মারামারির জন্য রিমান্ডের কী দরকার। প্রমাণ হলে সাজা হবে, না হলে খালাস পাবেন। এখানে রিমান্ডের কিছু নাই।’
এ মামলার আরেক আসামি এ বি সিদ্দিক দীপুকে গ্রেপ্তারের পর মঙ্গলবার আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাঁকেও তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছিলেন। আর এর আগের দিন ইরফানের গাড়িচালক মিজানুর রহমানকে এক দিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত।
মামলা তদন্তের নির্দেশ : রাজধানীর চকবাজার থানায় র্যাবের দায়ের করা ইরফান ও জাহিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে পৃথক দুটি করে মোট চারটি মামলা তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল বুধবার অস্ত্র আইনে দুটি মামলায় এজাহার আদালতে পৌঁছালে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদবীর ইয়াছির আহসান চৌধুরী তা গ্রহণ করে আগামী ১৭ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ইরফান ও জাহিদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলায় ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশিদ এজাহার গ্রহণ করে আগামী ৩ ডিসেম্বর তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
চকবাজার থানা সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার রাতে চকবাজার থানায় র্যাবের পক্ষ থেকে এই চারটি মামলা দায়ের করা হয়। সংসদ সদস্য হাজি সেলিমের বাড়িতে অভিযানের সময় তল্লাশিতে সেখানে আগ্নেয়াস্ত্র, মাদক ও ওয়াকিটকি পায় র্যাব। সেখানে ইরফানের কাছ থেকে অবৈধ একটি পিস্তল ও একটি অবৈধ এয়ারগান উদ্ধারের ঘটনায় অস্ত্র আইনে এবং কয়েক বোতল মদ পাওয়ায় মাদক আইনে মামলা করা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। একইভাবে জাহিদের কাছ থেকে একটি অবৈধ পিস্তল উদ্ধারের অভিযোগে অস্ত্র আইনে এবং ৪০৬টি ইয়াবা উদ্ধারের অভিযোগে মাদক আইনে মামলা করা হয়েছে। র্যাবের দায়ের করা অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলায়ও ইরফান ও জাহিদকে সাত দিন করে মোট ১৪ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন চকবাজার থানার ওসি মওদুত হাওলাদার।
ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েই চলছিল গাড়িটি : গত রবিবার রাতে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফের মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেওয়া ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-৫৭৩৬ নম্বরের গাড়িটির ফিটনেস ও ট্যাক্স টোকেন হালনাগাদ নেই। এ সত্ত্বেও ‘সংসদ সদস্য’ স্টিকার নিয়ে গাড়িটি নিয়মিত রাস্তায় চলাচল করছিল কিভাবে তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। পুলিশ ও যানবাহনের নিবন্ধন ও ফিটনেস সনদ দেওয়া বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো ব্রিটিশ ব্র্যান্ড ল্যান্ড রোভার গাড়িটির ইঞ্জিন ক্ষমতা ২৪৯৫ সিসি। এটি প্রথমে ইউরোপের একটি দেশের দূতাবাসের জন্য আনা হয়েছিল। পরে ২০০৪ সালে দূতাবাস গাড়িটি নিলামে তুললে অটোটেক লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান কিনে নেয়। কূটনৈতিক মিশন ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার জন্য আনা গাড়ি শুল্কমুক্ত। তবে বাংলাদেশে গাড়িটি বিক্রি করে দিলে ক্রেতাকে নিবন্ধনের সময় পুরো শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর ২০০৫ সালে গাড়িটির মালিকানা বদল করা হয়। তবে ২০১০ সাল থেকে এই গাড়ির ফিটনেস সনদ হালনাগাদ করা নেই। ২০০৫ সাল থেকে রোড ট্যাক্সও দেওয়া হয়নি। বর্তমানে এই শ্রেণির গাড়ির রোড ট্যাক্স বছরে ৭৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া প্রতিবছর ফিটনেস সনদ হালনাগাদের ফিও আছে। ফিটনেস ও ট্যাক্স টোকেন হালনাগাদ না থাকলে নির্ধারিত হারে জরিমানার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া ২০০৫ সালে গাড়িটির মালিকানা বদলের পর মালিক বিআরটিএর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, গাড়িটি ধানমণ্ডি থানায় আটক আছে।
চার মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে : গত মঙ্গলবার রাত ১২টার পর চকবাজার থানায় র্যাবের ডিএডি মো. কাইয়ুম ইসলাম অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ইরফান ও জাহিদের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে চারটি মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে কাইয়ুম ইসলাম বলেন, সোমবার সকালে তাঁরা ১০ জন বিশেষ অভিযান পরিচালনার সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে অবস্থান করছিলেন। এ সময় জানতে পারেন চকবাজারের দেবীদাস ঘাট লেনের ২৬ নম্বর বাসা ‘চান সর্দার দাদাবাড়ি’তে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্যসহ কয়েকজন ব্যক্তি অবস্থান করছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে ফোর্সসহ তখনই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে রওনা দেন তিনি। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে দুজন দৌড়ে ভবনের ওপরের দিকে উঠে যায়। তখন তাঁরা ভবনটিকে ঘেরাও করে ফেলেন। পরে চার সাক্ষীর উপস্থিতিতে র্যাব তল্লাশি চালায়। ভবনের চারতলায় দরজার ডান দিকে পশ্চিম দিককার ঘরে মো. জাহিদুল মোল্লাহকে পান তাঁরা। এ সময় কালো রঙের বিদেশি পিস্তল ও সাদা রঙের জিপারযুক্ত স্বচ্ছ এয়ারটাইট পলিপ্যাক থেকে ২০৩টি করে ৪০৬টি ইয়াবা উদ্ধার হয়। আর দুই পকেট থেকে উদ্ধার করা হয় দুটি ‘টাচ মোবাইল’। ওই ভবনের চারতলার অন্য পাশে পাওয়া যায় মো. ইরফান সেলিমকে (৩৭) । এ সময় তাঁর ব্যক্তিগত বিছানার তোশকের ডান পাশের নিচ থেকে পাওয়া যায় পিস্তল।
জাহিদুল ও ইরফান সেলিমের পিস্তল একই ব্র্যান্ডের। জাহিদুলের জিম্মা থেকে উদ্ধার বিদেশি পিস্তলটি কালো রঙের। ব্যারেলের একদিকে ইংরেজি হরফে লেখা মেড ইন ইউএসএ, অন্যদিকে লেখা অটো পিস্তল। পিস্তলের ওপরে লেখা আর্মি। পিস্তলটির ব্যারেলের দৈর্ঘ্য ছয় ইঞ্চি। বাঁট সাদা রঙের। বাঁটের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৭ ইঞ্চি। দুই রাউন্ড গুলিসহ একটি ম্যাগাজিন ছিল এতে। প্রতিটি গুলির গায়ে ইংরেজিতে লেখা কেএফ এবং ৭.৬৫। ইরফান সেলিমের কাছ থেকে পাওয়া গুলি ও ম্যাগাজিনের সংখ্যাও এক। এগুলোতেও ইংরেজিতে লেখা কেএফ ও ৭.৬৫। এ ছাড়া জব্দ তালিকায় এয়ারগান, কালো রঙের দুটি ছোরা, চাইনিজ কুড়াল, ৩৮টি কালো রঙের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ব্যাটারি, চার্জারসহ ওয়াকিটকি, হাতকড়াসহ ব্রিফকেস, একটি ক্যামেরাযুক্ত ড্রোন, বিয়ার ও মদের কথা বলা আছে। এজাহারে আরো বলা হয়েছে, অবৈধ অস্ত্র, গুলি ও মাদক বিষয়ে আসামিদের জিজ্ঞাসা করলে সন্তোষজনক জবাব কিংবা কোনো বৈধ কাগজপত্র পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় মামলা হওয়ার পর সোমবার দুপুরে চকবাজার দেবীদাস ঘাট লেন এলাকায় সংসদ সদস্য হাজি সেলিমের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ছেলে ইরফানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে মদ্যপান ও ওয়াকিটকি রাখায় তাঁকে এক বছরের সাজা দেওয়া হয়। পরদিন মঙ্গলবার ডিএসসিসির কাউন্সিলর পদ থেকে ইরফানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এর আগে ইরফান সেলিম ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ধানমণ্ডি থানায় হত্যাচেষ্টার মামলা হয়। নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমদ খান বাদী হয়ে সোমবার ভোরে মামলাটি দায়ের করেন। এ মামলার আসামিরা হলেন—ইরফান সেলিম, তাঁর বডিগার্ড মোহাম্মদ জাহিদ, হাজি সেলিমের মদিনা গ্রুপের প্রটোকল অফিসার এ বি সিদ্দিক দীপু, গাড়িচালক মিজানুর রহমানসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরো দু-তিনজন।
বাংলাদেশ সময়: ৮:৫১ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর ২০২০
dainikbanglarnabokantha.com | Romazzal Hossain Robel