| সোমবার, ২৩ নভেম্বর ২০২০ | প্রিন্ট
আতাউর রহমান খসরু: হিজরতের একাদশতম বছরে এবং বিদায় হজ থেকে ফেরার আড়াই মাস পর মহানবী (সা.) ইন্তেকাল করেন। স্ত্রী মায়মুনা (রা.)-এর ঘরে অবস্থানের সময় তিনি রোগাক্রান্ত হন এবং ১০ দিন অসুস্থ থাকার পর আয়েশা (রা.)-এর ঘরে তিনি ইন্তেকাল করেন। অসুস্থতার ১০ দিনে তিনি উম্মতকে বেশ কিছু উপদেশ দান করেন, যা উম্মতের জন্য তাঁর অসীম মমত্ব, ভালোবাসা ও দয়ার নিদর্শন। বিভিন্ন হাদিসে বর্ণিত এমন সাতটি অসিয়ত বা বিদায়ি উপদেশ এখানে তুলে ধরা হলো।
১. আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ : জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে তাঁর মৃত্যুর তিন দিন আগে বলতে শুনেছি, ‘তোমাদের কেউ যেন আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ না করে মৃত্যু বরণ না করে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩১১৩)
আল্লাহর প্রতি সুধারণা পরিপূর্ণ ঈমান ও সুস্থ মন-মস্তিষ্কের পরিচায়ক। আল্লাহর পরিচয় ও তাঁর প্রতি পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাসকারী আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ করে থাকে। আর আল্লাহর প্রতি সুধারণার অর্থ হলো—আল্লাহর দয়া, অনুগ্রহ ও ক্ষমা লাভের আশা রাখা। আল্লাহ মুমিনের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে যেসব পুরস্কার ঘোষণা করেছেন, তা প্রত্যাশা করে। একইভাবে পাপ ও শাস্তির ব্যাপারে আল্লাহ যেসব শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন তার ভয় পাওয়া। কেননা আল্লাহ প্রজ্ঞাময় ও ন্যায়বিচারক। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা ঈমান আনে, হিজরত করে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করে, তারাই আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে। আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২১৮)
২. নামাজে যত্নশীল হওয়া : আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্তিম মুহূর্তে তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাঁর অসিয়ত এই ছিল যে ‘নামাজ পড়বে এবং তোমাদের অধীনস্থদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৬৯৭)
ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম নামাজ। কোরআনে অসংখ্য জায়গায় নামাজ আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নামাজ সংরক্ষণের অর্থ হলো সময়মতো ও যথানিয়মে নামাজ আদায় করা। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নামাজের প্রতি যত্নবান হও; বিশেষত মধ্যবর্তী নামাজের প্রতি। আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে তোমরা দাঁড়াবে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৩৮)
এক সাহাবিকে নামাজে তাড়াহুড়া করতে দেখে মহানবী (সা.) তাঁকে বলেন, ‘তুমি ফিরে যাও এবং নামাজ পড়ো। কেননা তুমি (যথাযথভাবে) নামাজ পড়োনি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৬৬৭)
৩. কবরকে সিজদার জায়গা না করা : আয়েশা (রা.) ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) উভয়ে বলেন, যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) রোগ-যাতনায় অস্থির হতেন, তখন তিনি তাঁর কালো চাদর দিয়ে নিজ মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতেন। আবার যখন জ্বরের উষ্ণতা কমত, তখন মুখমণ্ডল থেকে চাদর সরিয়ে ফেলতেন।
বর্ণনাকারী বলেন, এরূপ অবস্থায়ও তিনি বলতেন, ‘ইহুদি ও খ্রিস্টানদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ। কেননা তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ (সিজদার জায়গা) বানিয়ে নিয়েছে। অথচ তাদের কৃতকর্ম থেকে সতর্ক করা হয়েছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৪৪৪)
ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, হাদিসে কবরকে কিবলা বা ইবাদতের অভিমুখ বানাতে নিষেধ করা হয়েছে। ফলে কবরের ওপর বা কবরের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করা যাবে না। ইহুদি ও খ্রিস্টানরা এমনটি করেছিল, যা তাদেরকে মূর্তিপূজা ও শিরকের দিকে নিয়ে গিয়েছিল।… এ হাদিসের আলোকে ইসলামী আইনজ্ঞরা বলেছেন, নবী ও আলেমদের কবরকে সিজদার জায়গা বানানো হারাম। (তাফসিরে কুরতুবি : ১০/৩৮০)
৪. অধীনস্থদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা : আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্তিম মুহূর্তে তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাঁর অসিয়ত এই ছিল যে ‘নামাজ পড়বে এবং তোমাদের অধীনস্থদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৬৯৭)
অধীনস্থ বলতে দাস-দাসী, শ্রমিক, ঘরের কাজের লোক থেকে ঘরের স্ত্রী-পরিজন সবাই উদ্দেশ্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) সব অধীনস্থের সঙ্গে উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তাআলা জীবনোপকরণে তোমাদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। যাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা তাদের অধীনস্থ দাস-দাসীদের নিজেদের জীবনোপকরণ থেকে এমন কিছু দেয় না, যাতে তারা তাদের সমান হয়ে যায়। তবে কি তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করে?’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৭১)
৫. সম্পদ ও প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা না করা : উকবা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা শিরকে জড়িয়ে যাবে আমি এ ভয় করি না। তবে আমার আশঙ্কা হয় যে তোমরা দুনিয়ায় সুখ-শান্তি লাভে প্রতিযোগিতা করবে। বর্ণনাকারী বলেন, আমের এ দর্শনই ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে শেষবারের মতো দর্শন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪০৪২)
৬. নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা : জীবনের শেষ ভাষণে মহানবী (সা.) নারীদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে বলেন, ‘হে মানুষ! নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো, নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। আমি তোমাদেরকে নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হওয়ার উপদেশ দিচ্ছি।’ (শরহু কাসিদাতিন নাবাবিয়্যা, পৃষ্ঠা ৩৪২)
৭. অন্যান্য অসিয়ত : এ ছাড়া ইন্তেকালের কাছাকাছি সময়ে মহানবী (সা.) আরো কিছু বিষয়ে অসিয়ত করেন। এর মধ্যে আছে আরব উপদ্বীপ থেকে অবিশ্বাসী ও পৌত্তলিকদের বের করে দেওয়া, আনসার সাহাবিদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা, মুসলমানের নেতৃত্বের প্রশ্নে আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-কে অগ্রাধিকার দেওয়া, অনাগত মুসলিমদের কাছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সালাম পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি।
আল্লাহ সবাইকে অসিয়তগুলো মান্য করার তাওফিক দিন। আমিন।
Posted ৩:৪০ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৩ নভেম্বর ২০২০
dainikbanglarnabokantha.com | Romazzal Hossain Robel
এ বিভাগের আরও খবর
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।