লাল চান মিয়ার মনে আজ ফুর্তি ফুর্তি ভাব। সে আজ একটা ক্যামেরা ফোন কিনেছে। একটা কম দামের বাটন ফোন যদিও তার ছিল। কিন্তু সেই ফোনে ছবি উঠে না। তার অনেকদিনের স্বপ্ন সে একটা ভাল ক্যামেরা ফোন কিনবে। নিজের রিকশায় বউ এবং মেয়েকে নিয়ে ঢাকা শহরের সুন্দর সুন্দর জায়গায় বেড়াবে আর পটাস পটাস করে ছবি উঠাবে। সেজন্য প্রতিদিনই সে কিছু টাকা আলাদা করে রেখেছে। আজ লাল চানের সেই স্বপ্ন পূরণের দিন। ঢাকা শহরের পাঁচ বছরের জীবনে এতটা খুশি সে কখনও হয়নি।
মেয়ে লাইলিকে সাথে নিয়ে লাল চান মিয়া বের হয়েছে। লাইলির বয়স মাত্র সাত বছর। সে রিকশায় একা বসে থাকতে পারবে কি-না সেই দুশ্চিন্তায় লাল চান মিয়া সাবলীলভাবে রিকশা চালাতে পারছে না। রিকশার হুড উঠিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে রিকশা চালাচ্ছে। ঢাকা শহরের রিকশা চালকরা ধীরে ধীরে রিকশা চালায় না। জ্যামের কারণে তারা ধীরে চালাতে বাধ্য হয়। রাস্তা ফাঁকা পেলে সকলে পূর্ণ গতিতেই চালায়। কেউ ধীরে চালালে অন্য রিকশা চালকরা তখন খুবই বিরক্ত হয়। লাল চানের ধীরে ধীরে রিকশা চালানোর কারণে পিছনের রিকশা চালকেরা পিছন থেকে নানান ধরনের কথা বলছে- ওই মিয়া ঘোড়ার ডিম চালাও; আরে মিয়া খাইয়া আস নাই; আরে মিয়া গায়ে শক্তি নাই ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ আবার গালিও দিচ্ছে। লাল চান মিয়া সব সহ্য করে যাচ্ছে। রিকশায় লাইলি থাকার কারণে সে খুবই বিব্রত হচ্ছে। কিছুটা রাগও হচ্ছে তার। কিন্তু তার আজ রাগ করলে চলবে না। সবার আগে মেয়ের নিরাপত্তা।
তার স্ত্রী বাতাসি বেগম থাকলে সে নিশ্চিন্তে জোরে জোরে চালাতে পারত। সে কখনো এত ধীরে ধীরে রিকশা চালায় না। ধীরে ধীরে রিকশা চালালে জোরও বেশি লাগে সময়ও নষ্ট হয়। আজকের এরকম একটা আনন্দের দিনে বাতাসি বেগম তার সাথে নাই। মনে হতেই লাল চান মিয়ার মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বাতাসি বেগমও বেড়াতে বের হবে সেরকমই প্লান ছিল। মোবাইল ফোনটা নিয়ে লাল চান মিয়া বাসায় পৌঁছার পর পরই হঠাৎ বাতাসির শরীর খারাপ হয়ে যায়। বমি করা শুরু করে। পর পর কয়েকবার বমি করায় শরীরটা তার দুর্বল হয়ে যায়।
লাল চান আজ বেরই হতে চাইনি। বাতাসি বেগমই জোর করে পাঠিয়ে দিল। বাতাসি বলল, লাইলি সকাল থেকে সাজগোজ করে বসে আছে। বেড়াতে যাবে। ছবি উঠাবে। আজ রিকশা নিয়ে বের না হলে লাইলি খুব কষ্ট পাবে। বাতাসির অনুরোধ সে ফেলতে পারেনি। কিন্তু লাল চান মিয়ার মন পড়ে আছে হাতিরপুলের ঐ ছাপড়া ঘরটিতে। যেখানে বাতাসি বেগমকে সে বিছানায় শুইয়ে রেখে এসেছে। লাইলিকে সাথে নিয়ে আজ সংসদ ভবন আর ধানমণ্ডি লেকের পাশে ছবি উঠিয়েই সে ফেরত আসবে।
রিকশা নিয়ে লাল চান মিয়া সুন্দর সুন্দর লোকেশনে থেমে রিকশায় লাইলিকে দাড় করিয়ে ফটাফট ছবি তুলতে লাগল। ক্যামেরায় পটাস করে আওয়াজ হওয়ার সাথে সাথে লাইলির মুখ খুশিতে জ্বলমল করে উঠতে লাগল। ছবি তোলার পরপরই সে বলছে, বাবা দেখি ছবিটা কেমন হল? লাল চান মিয়াও খুবই আগ্রহ নিয়ে দেখাতে লাগল। ছবি দেখে লাইলি মহাখুশি। স্কুলে ভর্তি করানোর সময় লাইলিকে একবার স্টুডিওতে নিয়ে ছবি উঠানো হয়েছিল। আর কখনো তার ছবি উঠানো হয়নি। ছবি তোলার জন্য সে আজ মুখে পাউডার মেখেছে, ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছে, চোখে কাজল দিয়েছে, হাতে চুড়ি পরেছে, মাথায় ফুলের ক্যাপ পরে মন ভরে সেজেছে। লাইলি তার ফুলের সাজসহ ছবিগুলো বিমুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখছে। কিন্তু লাল চান মিয়া বেশি ছবি উঠাতে পারল না। মোবাইলের চার্জ ফুরিয়ে গেল। নতুন ফোন দীর্ঘ সময় চার্জ দিতে হয়। দোকানদার সেটা লাল চান মিয়াকে বলেছেও। কিন্তু চার্জ দেয়ার জন্য যথেষ্ট সময় সে পায়নি। সংসদ ভবন পর্যন্ত গিয়েই তাকে ফেরত আসতে হল। অন্য কোথাও আর যেতে পারল না।
লাল চান মিয়া সপ্তাহে ছয়দিন রিকশা নিয়ে আয় করতে বের হয় আর একদিন ছুটি কাটায়। ছুটির দিনে সে মেয়ে লাইলি আর স্ত্রী বাতাসিকে নিয়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। ঢাকা শহরের সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলোতে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায় আর মোবাইলে ছবি উঠায়। ভাল ভাল কিছু ছবি প্রিন্ট করে অ্যালবামে সাজিয়ে রাখে।
লাল চান মিয়ার নিত্যদিনের কাজ হল- লাইলিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে স্কুলের সামনে থেকেই যাত্রী নিয়ে দিন শুরু করা। মেয়ে হাসি মুখে তাকে টা টা বলে স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে, এমন ছবি মাথায় নিয়ে সে সারাদিন ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে যাত্রী নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। লাইলির স্কুল ছুটির পর তাকে বাসায় নেয়ার দায়িত্বটা থাকে বাতাসি বেগমের। এভাবেই লাইলি একদিন পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে ফেলে।
*****
ষষ্ঠ শ্রেণিতে লাইলি ভর্তি হয় উদয়ন স্কুলে। লাল চান মিয়া আগের মতই লাইলিকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে রোজগারে নেমে পড়ে। মেয়েকে নিয়ে তার বড় আশা- একদিন সে বড় চাকরি করবে; বড় কিছু হবে; তার কোন অভাব থাকবে না। একদিন তার বাড়ি হবে, গাড়ি হবে। ঢাকা শহরের সুন্দর সুন্দর বাড়িগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে সে দেখে। কিন্তু সেরকম কোন বাড়ির ভিতরে যাওয়ার এবং দেখার সুযোগও তার কখনো হয়নি। প্রতিদিন বড়লোকদের কত সুন্দর সুন্দর গাড়ি সে ক্রস করে, গাড়ির ভিড়ে রাস্তায় সব সময় জ্যাম লেগে থাকে, কিন্তু কখনও সেরকম কোন গাড়িতে তার উঠার সৌভাগ্য হয়নি। মেয়েটাকে নিয়েই তার যত স্বপ্ন। একদিন লাইলি যদি তার স্বপ্ন পুরণ করে! লাইলি ছাড়া তার স্বপ্ন পূরণের আর কোন পথ নাই। সারাদিন মেয়ের হাসিমুখটা মাথায় নিয়ে বিপুল আনন্দ এবং উৎসাহ নিয়ে খেপ মারে। সময় নষ্ট করে না। সংসারের খরচ থেকে বাঁচিয়ে ভবিষ্যতে মেয়ের পড়ালেখার খরচের জন্য প্রতিমাসে কিছু সঞ্চয়ও করে।
একদিন সন্ধ্যায় লাইলি তার বাবাকে বলল, বাবা, আমি আর স্কুলে যেতে চাইনা। লাইলির কথা শুনে লাল চান মিয়া আর বাতাসি বেগম যেন আকাশ থেকে পড়ল- একি বলে লাইলি! তাকে নিয়ে এত আশা, এত স্বপ্ন, আর সে কিনা বলে স্কুলে যাবে না! লাল চান মিয়া হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন? কী হয়েছে মা?
-তেমন কিছু হয় নাই। আমরা গরীব মানুষ। আমাদের লেখাপড়ার কি খুবই প্রয়োজন?
-বলিস কি তুই! লেখাপড়া না করলে আমাদের এই গরীবী অবস্থার কখনও পরিবর্তন হবে? সুখের মুখ কখনো দেখতে পারবি?
-কেন? আমরা কি এখন সুখে নাই?
-এই সুখকে মানুষ সুখ মনে করে না। সত্যি করে বলতো কী হয়েছে তোর?
-আমাদের ক্লাসে যারা পড়ে তাদের অনেকেরই নিজের গাড়ি আছে। তারা নিজেদের গাড়িতে আসা-যাওয়া করে। আমার ক্লাসম্যাটরা বলাবলি করে- লাইলিদেরও নিজের গাড়ি আছে। তার বাবা নিজে ড্রাইভ করে এসে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যায়। সবাই কানা-কানি করে। ফিসফিস করে এটা-সেটা বলে। আমার ভাল লাগে না বাবা। আমি আর স্কুলে যাব না।
লাল চান মিয়া বুঝতে পারে লাইলিকে নিজে রিকশা চালিয়ে স্কুলে পৌঁছে দেয়া তার ঠিক হয়নি। লাইলি এখন হাই স্কুলে পড়ে। তার বন্ধু-বান্ধবরা হাই স্কুলের ছাত্র। তারা এখন তাদের পারিবারিক স্ট্যাটাস বুঝতে পারে। বিষয়টি নিয়ে সে খুব ভাবনায় পড়ে গেল। একটা সম্ভাব্য সমাধানও সে চিন্তা করে বের করল।
লাল চান মিয়া নীলক্ষেত হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে লাইলির সমস্যাটি নিয়ে কথা বলল। প্রধান শিক্ষক আশ্বস্ত করলেন। তার স্কুলে নিম্ন আয়ের পরিবারের অনেক ছেলে-মেয়ে পড়ালেখা করে। কাজেই তার স্কুলে কোন সমস্যা হবে না।
লাইলিকে লাল চান মিয়া নীলক্ষেত হাই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিল। লাল চান মিয়া দ্বিতীয়বার ভুল করল না। সে হেঁটে হেঁটে মেয়ের সাথে স্কুলে যায়। লাইলির সাথে স্কুল পর্যন্ত না গেলে তার ভাল লাগে না। সে দিন শুরু করতে চায় লাইলির হাসি মুখটা দেখে। কিন্তু লাইলির মুখে সেই আগের হাসি নাই। লাল চান মিয়ার খুব কষ্ট হয়। কিন্তু মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে কষ্ট সয়ে যায়। বাতাসি বেগম লাল চান মিয়াকে স্কুলে যেতে মানা করে। কিন্তু লাল চান মিয়ার মন মানে না।
লাইলি যাতে আর কোথাও বিব্রতকর অবস্থায় না পড়ে সেজন্য লাল চান মিয়া ঠিক করে সে ঢাকা শহরের বাইরে রিকশা চালাবে। সে ভোরবেলা চলে যায় নারায়ণগঞ্জে। তারপর সারাদিন রিকশা চালিয়ে রাতে বাসায় ফিরে আসে। লাল চান মিয়া যখন রিকশা চালিয়ে দোয়েল চত্বর শহিদ মিনার হয়ে বাসায় ফিরে তখন সে খুব স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। মেয়ে যখন ছোট ছিল তখন এই জায়গাগুলোতে তার কত চমৎকার সময় কেটেছে! মেয়েও বড় হল আর তার আনন্দের দিনও যেন চলে গেল! মেয়ের লেখাপড়া বাড়তে লাগল আর সেও দূরে সরে যেতে থাকল।
লাইলি এসএসসি পাশ করেছে। লাল চান মিয়ার যেন আনন্দ ধরে না। তার চৌদ্দ পুরুষের মধ্যে মেট্রিক পাশ কেউ নাই। লাইলি যেন বংশকে আলোকিত করার মশাল হিসেবে হাজির হয়েছে। লাল চান মিয়া যেন তার স্বপ্ন পুরণের দিকে এক ধাপ এগিয়ে গেছে। কিন্তু বাতাসি বেগম চায় লাইলি আর পড়ালেখা না করুক। লাল চান মিয়া সেই কথা শুনতে পারে না। রেগে যায়। মেয়েকে তার পড়ালেখা করাতেই হবে। মেয়ে ছাড়া তার স্বপ্ন পুরণের অন্য কোন বিকল্প পথ নেই।
বাতাসি বেগম মেয়ের জন্য পাত্র ঠিক করেছে। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিবে। ছেলে ভাল। সিএনজি অটোরিক্সা চালায়। মাসে ভাল আয় করে। ভাল বাসায় থাকে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে তার মাথা থেকে বোঝা নেমে যাবে। চার পাশে কত বদ ছেলে ঘুরাঘুরি করে। কখন কি করে বসে ঠিক নাই। লাল চান মিয়া রাজি না থাকায় সে বিয়ে দিতে পারে না।
পাশের বাসার আসকর লাইলিকে পছন্দ করে। বিয়ে করতে চায়। আসকরের বাবাও রিকশা চালায়। আসকর কিছু করে না। বাদাম্যা এবং বখাটে ছেলে। সে হুমকি দিয়েছে লাইলিকে তার কাছে বিয়ে না দিলে এসিড মারবে। লাল চান মিয়া ভয় পায়। যদি সত্যিই সত্যিই এসিড মারে! সে নানান কিছু ভাবে। কী করা যায়? একদিন আসকরকে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়। লাল চান মিয়া যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে।
প্রায় দু’বছর আসকর জেল হাজতে আটক থাকে। এই সময়ের মধ্যে লাইলি কলেজে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যায়। লাইলি এইচএসসিতে ভাল রেজাল্ট নিয়ে পাশ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় সেদিন আসকর জেল থেকে ছাড়া পায়। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই আসকর লাইলিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। লাল চান মিয়া সরাসরি না বলে দেয়। আসকর বিয়েতে প্রত্যাখাত হয়ে খুবই ক্ষিপ্ত হয়। সে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।
একদিন রাতের অন্ধকারে আসকর লাল চান মিয়ার ঘরের জানালা দিয়ে এসিড ছুড়ে মারে। এসিড গিয়ে পড়ে বাতাসি বেগমের মুখে। সাথে সাথেই সে চিৎকার শুরু করে। তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। বাতাসি বেগমকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তার শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কয়েকদিন পর মারা যায়। লাইলি ঐ সময় বাথরুমে থাকায় সে বেঁচে যায়।
স্ত্রীর শোকে লাল চান মিয়া পাগল প্রায় হয়ে যায়। লাইলিও মা হারানোর শোকে পাথর হয়ে যায়। বাতাসি বেগম মারা যাওয়ার কয়েকদিন পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। লাইলি অর্থনীতিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। মা হারানোর তীব্র কষ্ট নিয়েই লাইলি ভর্তির কার্যক্রম শেষ করে।
লাল চান মিয়ার হাতিরপুলের বাড়িতে থাকতে ভাল লাগে না। যে দিকেই তাকায় শুধুই বাতাসির স্মৃতি চোখে পড়ে। সে কোনভাবেই যেন তাকে ভুলতে পারছে না। তারপর আছে আসকরের ভয়। আসকর পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সে কোন ফাঁকে এসে আবার লাইলির গায়ে এসিড মারে। সবকিছু ভেবেচিন্তে লাল চান মিয়া ঠিক করে সে আর ঢাকা শহরে থাকবে না। লাইলি বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে উঠে যায়। আর লাল চান মিয়া চলে যায় শেরপুর সদর উপজেলার কুতুবপুর গ্রামে।
*****
গ্রামের পুরনো ভিটায় একটা চালা তুলে লাল চান মিয়া বসবাস শুরু করে। তার ছোট্ট ঘরে বাতাসি নাই। একা একা তার ভাল লাগে না। বাতাসির কথা মনে করে নীরবে সে চোখ মুছে। আর লাইলির কথা মনে হলে তার মুখটা যেন আশার আলোতে চকচকে হয়ে উঠে। লাল চান মিয়ার বয়স হয়েছে। এখন তার গায়ে আর আগের মত জোর নেই। তবুও অন্ন সংস্থানের জন্য তাকে রিকশা চালাতেই হয়। গ্রামের রাস্তা এখন পাকা হয়েছে। এখন মানুষ রিকশায় উঠে। প্রতিদিন যা আয় হয় তাতে লাল চান মিয়ার দিন চলে যায়। মেয়েটার জন্য সে টাকা পাঠাতে পারে না। সেজন্য মনে মনে সে খুব কষ্ট পায়। মেয়েটা প্রতিদিনই ফোন করে। বাবার খোঁজ নেয়, আশ্বস্ত করে। সে এখন ছাত্র পড়িয়ে নিজের খরচ নিজেই যোগাড় করছে।
লাল চান মিয়া গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের সামনে গিয়ে ছোট্ট শিশুদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে এবং গুটি গুটি পায়ে ক্লাসে প্রবেশ করা দেখে প্রতিদিনের কাজ শুরু করে। প্রতিদিন সকালবেলা রিকশা নিয়ে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের দিকে যায়। পথে ছোট্ট শিশু যাদেরকে পায় তাদেরকে বলে, বাবুরা আমার রিকশায় উঠ। টাকা লাগবে না। তোমাদের স্কুলে দিয়ে আসব। শিশুরা হুড়মুড় করে রিকশায় উঠে পড়ে। সিটে জায়গা হয় না। কেউ কেউ চালক সিটের রড ধরে নিচে বসে পড়ে। কেউবা রিকশার পিছনে বাম্পারের মত লোহার দণ্ডটিতে দাড়িয়ে পড়ে। শিশুরা যাতে কেউ পড়ে গিয়ে ব্যথা না পায় সেজন্য লাল চান মিয়া হেঁটে হেঁটে স্কুল পর্যন্ত রিকশাটা টেনে নিয়ে যায়। শিশুদের সাথে খোশগল্প করে। কে কী খেয়েছে, কোন ক্লাসে পড়ে, কোন বিষয় পড়তে ভাল লাগে, বড় হয়ে কী হতে চায় এই সমস্ত বিষয় নিয়ে কথা বলে। স্কুলের কাছে পৌঁছলে শিশুরা আবার হুড়মুড় করে নেমে দৌড়ে স্কুলের মাঠে চলে যায়। লাল চান মিয়া এক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। শিশুদের মাঝে সে যেন তার কলিজার টুকরা লাইলিকে দেখতে পায়। লাইলিই যেন তাকে টা টা বলতে বলতে স্কুলের ভিতরে চলে যায়।
****
লাইলি রোকেয়া হলে থাকে। তার চিন্তা-চেতনায় সব সময় থাকে পড়ালেখা আর পড়ালেখা। পড়ালেখার ফাঁকে বিকালে সে দুইটা টিউশনি করায়। বাবা-মা ছাড়া কোন আত্মীয়-স্বজনকে সে কখনও দেখেনি। মা চলে গেছেন ইহকাল ছেড়ে। বাবার সাথেও দেখা হয় না। তাদের কথা মনে হলে তার দু’চোখে অশ্রুর বান ছুটে। নিজেকে সামলে নেয় সে। বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য খুব দ্রুতই আবার পড়ালেখায় মনোনিবেশ করে। এক মুহুর্ত সময় নষ্ট হলেই তার কাছে মনে হয় তার বাবা যেন কষ্ট পাচ্ছে। তার বাবা যেন বলছে, লাইলি মা আমার, সময়কে তুমি আটকাতে পারবে না জানি। কিন্তু তাকে কাজে না লাগিয়ে তুমি ছেড়ে দিও না। নইলে সে তোমার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে ভুল করবে না।
মাঝে মাঝেই সে রিকশায় দাঁড়িয়ে উঠানো বাল্যকালের সেই ছবিগুলো বের করে দেখে। নিজের অজান্তেই তার চোখ ভিজে যায়। মাঝে মাঝেই একাকি সে জাদুঘরের সামনে, কবি নজরুলের সমাধির সামনে, শহিদ মিনারের বেদিতে গিয়ে তার বাল্যকালের মধুর স্মৃতিগুলো স্মরণ করে, আর সবার অলক্ষ্যে ওড়নার কোণা দিয়ে চোখ মুছে।
লাইলির অনার্স শেষ হয়েছে। অনার্স পাশ সার্টিফিকেট দিয়েই সে বিভিন্ন চাকুরির আবেদন করা শুরু করে। মাস্টার্স পরীক্ষা যেদিন শেষ হয় সেদিনই সে একটি ব্যাংক থেকে চাকুরির নিয়োগ পত্র হাতে পায়। চাকুরিটা তার পছন্দের তালিকার শেষের দিকের। তারপরও সে খুবই আনন্দিত হয়। আপাতত এই চাকরিতেই সে জয়েন করবে। পরে পছন্দের চাকরি পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবে। লাল চান মিয়াকে সে খবরটা জানায় না। লাইলি চায় আগে সে চাকরিতে জয়েন করবে তারপর ছুটি নিয়ে বাবার কাছে হঠাৎ একদিন হাজির হয়ে খবরটা দিবে। বাবার অনুভূতিটা স্বচক্ষে দেখবে সে।
*****
গ্রামে লাল চান মিয়ার অপরাধের বিচারের জন্য সালিস বসেছে। লাল চান মিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে কাসু মিয়ার ছেলেকে রিকশা থেকে ফেলে দিয়ে হাত ভেঙ্গে দিয়েছে। লাল চান মিয়া বলছে, আমি তার হাত ভেঙ্গে দেয়নি। আমার রিকশার সিটে বসেছিল তিনজন, পিছনে উঠেছিল দুইজন, আর দুইজন বসেছিল চালকের সিটের নিচের রড ধরে। আর কোন জায়গা না থাকলেও ছেলেটি জোর করে উঠতে গিয়ে পড়ে যায়। কিন্তু তার ঐ যুক্তি শুনতে গ্রামের মাতবররা নারাজ। কাসু মিয়া তাকে মারার জন্য তেড়ে আসে। অন্যরা তাকে থামায়। কাসু মিয়া বলে, তুই গ্রামে কেন এসেছিস? রিকশা নিয়ে ভং করতে তোকে কে বলেছে? কেউ কেউ লাল চান মিয়ার সুন্দর-সরল মনের প্রশংসা করে। ঘটনাটিকে একটা নিছক দুর্ঘটনা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু তা ধূপে টিকে না। একজন রিকশাওয়ালার সুন্দর মন থাকার প্রয়োজন আছে নাকি? সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রেক্ষিতে রায় দেয়া হয়- লাল চান মিয়াকে পঞ্চাশ ঘা জুতাপেটা করা হবে এবং ভবিষ্যতে সে কোন শিশুকে আর রিকশায় উঠাতে পারবে না।
রায় তাৎক্ষণিক কার্যকর করার জন্য ফরাশ মিয়াকে দায়িত্ব দেয়া হল। ফরাশ মিয়া লাল চান মিয়ার দিকে এগিয়ে গেল। লাল চান মিয়ার পক্ষে যারা কথা বলেছে তাদের সহ্য হচ্ছিল না। কিন্তু সালিসের সিদ্ধান্তের বাইরে তারা যেতেও পারছে না। ফরাশ মিয়া যেই মুহুর্তে পায়ের জুতা খুলে হাতে নিল ঠিক সেই মুহুর্তেই লাইলি বাড়িতে উপস্থিত হল। ফরাশ মিয়া লাইলিকে দেখে থেমে গেল।
লাল চান মিয়া লাইলিকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল- মা আমার, তুই এসেছিস! কত দিন তোকে দেখি না। তুই কেমন আছিস? আমাকে তো খবর দিতে পারতি। আমি তোকে রিকশা করে নিয়ে আসতাম। বাবার কান্নার সাথে মেয়েও কান্না শুরু করল- বাবা তোমার আশা পূরণ হয়েছে। আমি অফিসার হয়েছি। অফিসার পদে জয়েন করে ছুটি নিয়ে এসেছি। তোমাকে আর রিকশা চালাতে হবে না বাবা।
লাইলি অফিসার হয়েছে কথাটা শোনার সাথে সাথেই সালিসের লোকজনের মুখ পাংশু বর্ণ হয়ে গেল। লাইলি যাতে তাদেরকে চিনতে না পারে সেজন্য যে যার মত করে নীরবে কেটে পড়ল। শুধু থাকল লাল চান মিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল কয়েকজন।