| রবিবার, ২৫ জুলাই ২০২১ | প্রিন্ট
মো. জালাল উদ্দিন:
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই মনে হল আমার বাবা যেন লাঠি হাতে গেটে দাঁড়িয়ে আছেন আমাকে মারবেন বলে। হঠাৎ কেন এই বিষয়টি আমার মাথায় এল সেটা ভেবে আমি নিজের কাছে নিজেই যেন অবাক হলাম। তবে হ্যাঁ, বাবা লাঠি হাতে আমাকে মারার জন্য একসময় বাড়িতে বসে থাকতেন। তখন আমি হাই স্কুলে পড়তাম। বাবা চাইতেন না আমি পড়ালেখা করি। তাই স্কুল ছুটির পর যখন বাড়িতে পৌঁছতাম তখন বাবা লাঠি হাতে তেড়ে আসতেন আমাকে মারার জন্য। আমি আমার বইগুলো বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দৌঁড়াতে থাকতাম। বাবা ক্লান্ত হয়ে ফিরে গেলে চুপি চুপি বাড়িতে যেতাম।
বাড়ি বলতে সে অর্থে বাড়ি নয়। রাস্তার ঢালে ছাপড়া ঘর। পাশাপাশি দু’টি ঘরের একটাতে বাবা মা আর অন্যটাতে আমি থাকতাম। ব্রহ্মপুত্রের বন্যায় বাড়িঘর তলিয়ে গেলে আমরা রাস্তার ঢালে ছাপড়া উঠিয়ে বসবাস শুরু করি। বন্যার পানি শুকিয়ে গেলেও আমরা সেখানেই থেকে যাই। বাবা ছিলেন অসুস্থ। দিনমজুরি ছিল তার পেশা। অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজ করতে পারতেন না বলে তিনবেলা খাবার জুটত না আমাদের। তাই তিনি চাইতেন, আমি যেন পড়ালেখা ছেড়ে কাজ করে কিছু রোজগার করি। বাবা ইহকাল ছেড়েছেন সেই কবে! আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র।
লাগেজের জন্য বেল্টের কাছে দাঁড়িয়ে বাবার কথা ভাবতে ভাবতে যেন কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম। মনে মনে বাবাকে স্মরণ করে বললাম, বাবা তুমি দেখে যাও, যে ছেলেকে স্কুল ছাড়ার জন্য লাঠি হাতে তুমি দৌঁড়িয়েছ, যে ছেলের দেশেই পড়ালেখা করার সামর্থ্য ছিল না, আজ সে বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরেছে!
বেল্টে লাগেজ ঘুরছে। সামনে দিয়েই আমার লাগেজ চলে গেল। কিন্তু ধরতে ইচ্ছে হল না। অসহায় লাগেজ মালিকের খোঁজে পুর্নবার চক্কর দিতে লাগল। চক্কর ঘুরে আবারও আমার সামনে আসার আগে পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করে চোখটা মুছে নিলাম। কাছে আসামাত্র লাগেজটি ধরে বাসার দিকে রওনা হলাম। ইস্কাটন গার্ডেনে আমার বাসা। ঠিক আমার বাসা নয়, আমার পাতানো মায়ের বাসা।
টার্কিস এয়ারলাইন্সে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন এয়ারপোর্ট থেকে ইস্তাম্বুল হয়ে ঢাকায় পৌঁছতে আমার প্রায় বিশ ঘণ্টা লেগে গিয়েছে। পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে লম্বা একটা ঘুম দিলাম। ঘুম থেকে উঠেই মাকে বললাম, মা, আমাকে সখিনার ঋণ শোধ করার জন্য কুতুবপুর যেতে হবে। মা একদম হকচকিয়ে গেলেন।
-কে সখিনা? সখিনার কথা তো কখনও আমাকে বলিসনি!
-তোমাকে অনেক কথাই বলা হয়নি মা। তাছাড়া তুমি কখনো জানতেও চাওনি। এই যেমন ধর, তুমি জান- আমি এতিম। কিন্তু আমার মা-বাবা কে? তারা কেউ জীবিত আছেন কিনা, সে ব্যাপারে তুমি কখনও কিছু জানতে চাওনি।
-সেটা আমি ইচ্ছা করেই জানতে চাই নি। কারণ, আমি জানি অনেক শিশু আছে যাদের পিতার পরিচয় থাকে না। সেরকম যদি কিছু তোর বেলায় ঘটে থাকে। সে আশঙ্কায় তোর বাবা-মা নিয়ে আমি কখনও কোন কথা বলিনি। তুই নিজ থেকেই যখন আজ বলতে চাচ্ছিস তাহলে বল তোর বাবা-মার কথা শুনি।
-আমি যখন শেরপুর থেকে ঢাকায় আসি তখন আমার মা জীবিত ছিলেন।
-হায় আল্লাহ! এতদিন বলিসনি কেন? যা, আজই চলে যা। তাঁকে নিয়ে আয়। এই বিশাল বাড়িতে বলতে গেলে আমি একাই থাকি। তোর মা আমার সাথেই থাকতে পারবে।
-না, মা। সেটা সম্ভব নয়। বাবা মারা যাওয়ার পর আমার মার যেদিন দ্বিতীয় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা চলছিল সেদিনই আমি প্রচণ্ড মন খারাপ করে কাঁদতে কাঁদতে ঢাকায় রওনা হই। এখন তিনি কোথায়, কেমন আছেন কিচ্ছু জানি না। আমি আমার মার খোঁজে কুতুবপুর যাচ্ছি না, মা। আমি যাচ্ছি সখিনার খোঁজে।
-তুই অনেক শিক্ষিত হয়েছিস। তোকে আমার জ্ঞান দেয়ার কিছু নেই। তারপরও বলছি, সখিনার কাছে যদি তোর ঋণ থাকে, তাহলে তোর মার কাছে কেন ঋণ থাকবে না? তোর মাকেও খোঁজে বের করিস। আর সখিনার কাছেইবা তোর কিসের ঋণ?
-সখিনা আমার কাছে পনের হাজার টাকা পাবে, মা। কিন্তু মা, টাকার অংকটা যাই হোক না কেন, তার প্রতিটি টাকা আমার পায়ের নিচে একটু একটু করে শক্ত ভিত তৈরি করে দিয়েছে। তার সেই ঋণ টাকার অংকে বিবেচনা করা যাবে না। টাকার অংকে কখনো শোধও করা যাবে না।
-কিন্তু কেন? আমাকে কি বলা যাবে?
-হ্যাঁ মা। বলছি তোমাকে- আমি তখন কুতুবপুর হাই স্কুলে সবে নবম শ্রেণিতে উঠেছি। সখিনাও নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। সখিনা আগে ঢাকায় পড়ালেখা করত। শেরপুর সদর উপজেলার কুতুবপুর গ্রামে হল তার নানার বাড়ি।
-সে লেখাপড়া করতে ঢাকা থেকে গ্রামে গেল কেন?
-তার মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎমা তাকে সহজভাবে নিতে পারেননি। তাই তার বাবা তাকে তার নানারবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। নবম শ্রেণিতে সবেমাত্র ক্লাস শুরু হয়েছে তখন। আমি প্রতিদিন সবার আগে ক্লাসে গিয়ে একদম পিছনের বেঞ্চে বসে থাকি। আবার সবার পরে ক্লাস থেকে বের হই। টিফিনের সময় সবাই যখন গল্প-গুজব করে, টিফিন খায়, তখনও আমি বসে থাকি। একদিন দুপুরে আমি খুবই ক্ষুধার্ত। সকালে খেয়ে আসিনি। বিষণ্ন মনে ক্লাসরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে আছি। ঠিক তখনই সখিনা ক্লাসরুমে প্রবেশ করে। তার সাথে আমার চোখাচোখি হয়। আমি মাথা নিচু করে বইয়ের পাতা উল্টাতে থাকি।
সখিনার সাথে তখনও আমার পরিচয় হয়নি। কোন কথাও হয়নি। সেদিন স্কুল ছুটির পর সবাই একে একে চলে যায় কিন্তু সে নীরবে বসে থাকে। সে বসে থাকায় আমিও বের হতে পারছিলাম না। আমি চুপি চুপি বের হওয়ার চেষ্টা করি। সে হঠাৎই বলে উঠে, এই দাঁড়াও। আমি থতমত হয়ে দাঁড়িয়ে যাই। তোমার নাম কি? আমি বলি, আমার নাম সাদ্দাম। সে জিজ্ঞেস করে, তুমি সবসময় পিছনের সিটে সারাদিন চুপচাপ বসে থাক কেন? আমি ইতস্ততঃ করতে লাগলাম। বলতে চাচ্ছিলাম না। সে কিছুটা ধমকের সুরে বলল, বলছ না কেন? বল। আমি তাকে বললাম, আসলে আমার একটিমাত্র শার্ট। শার্টটার পিছনে ছিঁড়ে গেছে। সেজন্য সবসময় পিছনের সিটে বসে থাকি যাতে কেউ দেখতে না পারে। সবাই বের হওয়ার পর আমি বের হই, যাতে আমার ছেঁড়া শার্ট কেউ দেখে না ফেলে। আমার কথা শুনে তার চোখ যেন ছল ছল করতে লাগল। তার পার্স খুলে এক হাজার টাকার একটি নোট বের আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি নিতে চাচ্ছিলাম না। আমাকে ধমক দিয়ে বলল, নাও। এটা আমি দান করছি না, ধার দিচ্ছি। তুমি যখন খুশি পরিশোধ করবে। আর আগামীকাল থেকে এভাবে বসে থাকবে না।
পরদিন সে আমার নিকট জানতে চাইল আমার এ দুর্দশার কারণ কি? আমি তাকে বললাম, আমার বাবা অসুস্থ থাকায় তিনি ঠিকমত কাজ করতে পারেন না। আমাদের ঘরে সবসময় খাবারও থাকেনা। বাবা চান আমি যেন কাজ করি। তবে আমার মার সম্মতি থাকলেও অভাবের তাড়নায় তিনিও পড়ালেখা ছেড়ে দিতে বলেন। সখিনা বলে, তোমার পড়লেখা ছাড়ার কোন প্রয়োজন নেই। আমার বাবার অনেক টাকা-পয়সা আছে। আমার নামে ব্যাংকে একটা একাউন্টও আছে। সেখানে বাবা অনেক টাকা জমা রেখেছেন। আমি যত ইচ্ছা সেখান থেকে খরচ করতে পারি। তোমার যত প্রয়োজন আমার কাছ থেকে ধার নিতে পার। তবে তুমি ইচ্ছা করলে টিউশনি বা অন্যকোন কাজ করে তোমার বাবাকে সহযোগিতা করতে পার।
বিপদে-আপদে ধার-কর্জ চাওয়ার মত তেমন কেউ আমার ছিল না। সখিনা আমার জীবনে যেন অমাবস্যার আঁধারে দিকভ্রান্ত পথিকের সম্মুখে একগুচ্ছ আলোক রশ্মি হিসেবে আবির্ভূত হল। পরের দিন থেকেই আমি যেন পরিণত হলাম অন্য এক সাদ্দামে । অনিশ্চয়তার কালোমেঘ কেটে গিয়ে যেন আকাশে আগমন ঘটে ঝলমলে সূর্যের। আমার জীবনে ফিরে আসে শিশুতোষ উদ্দামতা ও উচ্ছ্লতা। তারপর থেকেই ছুটির দিনে কৃষি দিনমজুর, রাজমিস্ত্রীর যোগালি কখনওবা মাটি কাটার কাজ করে বাবাকে সহযোগিতা করা শুরু করি। কায়িক শ্রমের ঐ কাজগুলো করেও আমি যেন নির্মল আনন্দ উপভোগ করি। লেখাপড়ার খরচের টাকা ধার করি সখিনার কাছ থেকে। এভাবে আমার পনের হাজার টাকা দেনা হয়ে যায়। যেদিন আমার এসএসসির টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয় সেদিনই আমার বাবা মারা যান।
বাবা হারানোর প্রচণ্ড কষ্ট বুকে নিয়েই পড়ালেখা চালিয়ে যাই এবং যথারীতি এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার কিছুদিন পর আমার মার বিয়ে ঠিক হয় আমার এক দূর সম্পর্কের চাচার সাথে। যেদিন বিয়ে হয় সেদিনই আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে জামালপুর চলে যাই। সেখান থেকে ট্রেনে উঠে চলে আসি ঢাকায়।
তারপর এক যুগের বেশি সময় চলে গেছে। গ্রামে যায়নি। যাওয়ার ইচ্ছাও হয়নি কখনও। আজ যেতে ইচ্ছা করছে। সখিনার টাকাটা ফেরত দিতে পারলে অন্ততঃ কিছুটা স্বস্তি পাব।
-তোর উপর এত ঝড়-ঝাপ্টা বয়ে গেছে তার কিছুই আমি বুঝতে পারিনি। খুব অন্যায় হয়ে গেছে আমার। তোর বাল্যকালের খোঁজ-খবর নেয়াটা আমার উচিত ছিল।
-কোন অন্যায় হয়নি মা। জিজ্ঞেস না করে ভালই করেছ। সফল হতে পারলে জীবনের কষ্টের কথাগুলো বলে আত্মতৃপ্তি অর্জন করা যায়। সফল হওয়ার আগে কষ্টের কথা বলে অন্যের অনুকম্পা নেয়া বোকামী ছাড়া কিছু না। আমি সফল হতে পেরেছি বলেই আজ আমি আমার কষ্টের অতীতকে নিয়ে গর্ব করতে পারি।
-আচ্ছা বলতো সাদ্দাম, তোর যদি আমার বাড়িতে আসা না হত তাহলে তুই কীভাবে সফল হতি? সফল হওয়ার জন্য তখন তোর কী পরিকল্পনা ছিল?
-তুমি জান মা, তোমার বাড়িতে আসার আগে আমি একদল নির্মাণ শ্রমিকের সাথে কাজ করতাম। প্রাথমিকভাবে ঢাকা শহরে সেট হওয়ার জন্য আমার সেটার প্রয়োজন ছিল। আমি তখন কাজ করে টাকা জমাচ্ছিলাম কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য। কাজের ফাঁকে আমি সিএনজি অটোরিক্সা চালনা শেখার প্লান করি এবং ভেবে রাখি কলেজে ভর্তি হওয়ার পর পড়ালেখার পাশাপাশি সিএনজি অটোরিক্সা চালাব। কখনও যদি টাকা পয়সার সংকটে পড়ি তাহলে চলে যাব সখিনার কাছে ধার চাইতে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আমি একদিন বড় কিছু হবই। তোমার সহযোগিতা আমার সফল হওয়ার পথকে মসৃণ করে দিয়েছে। বড় হওয়ার জন্য সকলকেই কারও না কারও কাছ থেকে সহযোগিতা নিতেই হয়, মা।
-সখিনার ঋণ শোধ করার জন্য তুই গ্রামে যাচ্ছিস, কিন্তু আমার ঋণ শোধ করবি কীভাবে?
-তোমার ঋণ তো দূরের কথা মা, সখিনার ঋণও আমার দ্বারা শোধ করা সম্ভব নয়। আমাকে তোমাদের কাছে চিরঋণী হয়েই থাকতে হবে।
*****
কুতুবপুর গ্রামের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কিছু কিছু জায়গা চেনাই দায়। কুতুবপুরে পৌঁছেই প্রথমে আমি গেলাম রাস্তার সেই ঢালে, যেখানে আমাদের ঘর ছিল। সেখানে কোন ঘরই চোখে পড়ল না। লোকজনের কাছে জানতে পারলাম, রাস্তার ঢালে যারা বাড়ি নিয়ে থাকত তাদেরকে সরকার অন্যত্র পুনর্বাসন করেছে। সরকার তাদেরকে ঘর এবং জমি দিয়েছে। তারপর হাজির হলাম সখিনার নানার বাড়ি।
সখিনার নানাকে বাড়ির আঙ্গিনাতেই পেলাম। আমাকে তিনি চিনতে পারলেন না। পরিচয় দেয়ার পর চিনতে পারলেন এবং হাউমাউ করে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। আমাকে দেখে কান্নার কী হল? কিছুই বুঝতে পারলাম না। তিনি শান্ত হয়ে বললেন, সখিনা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে রে ভাই। বলেই, আবারও কান্না শুরু করলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, সেদিন ছিল সখিনার বিয়ের দিন। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বরের সাথে শ্বশুরবাড়ি রওনা হয়। পথে ট্রাকের সাথে সংঘর্ষে বর-কনেবাহী গাড়ি দুমড়ে-মোচড়ে যায়। বর-কনে দুর্ঘটনাস্থলেই মারা যায়।
আমি এভাবে সখিনার মৃত্যুর সংবাদ শুনবো তা স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি। সখিনার মৃত্যুসংবাদ এবং বৃদ্ধের কান্না আমাকে মারাত্মকভাবে আহত করল। বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলাম। বৃদ্ধ বললেন, তুই চলে যাওয়ার পর আমরা তোকে অনেক খুঁজেছি। সখিনা মাঝে মাঝেই তোর মার কাছে গিয়েছে তোর সংবাদ জানতে। কেউ কোন সংবাদ দিতে পারে নাই।
তোর জন্য আরেকটা দুঃসংবাদ আছে। তোর মাও গতবছর মারা গেছে। আমি স্তব্দ হয়ে গেলাম। আমার ঠোঁট কাপতে লাগল। চোখে ঝাঁপসা দেখতে লাগলাম। মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হল না। ফ্যাল ফ্যাল করে অশ্রুভরা নয়নে বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ততক্ষণে বেশকিছু লোক জড়ো হয়ে গেছে। তারা কৌতূহলভরে আমাদের কান্না উপভোগ করছে। নিজেদের মধ্যে কানাকানি করছে, লোকটা কে? এখানে এসে কাঁদছে কেন? আমি আস্তে আস্তে উঠে ধীরপদে কুতুবপুর হাইস্কুলের দিকে রওনা হলাম।
স্কুলে তখন টিফিন পিরয়ড চলছে। আমি শিক্ষকদের কমন রুমে প্রবেশ করলাম। আমাকে দেখে পরিচিত শিক্ষকরাও অনেকে চিনতে পারলেন না। বয়ষ্ক শিক্ষক যারা ছিলেন তারা সবাই অবসরে চলে গেছেন। বেশিরভাগই নতুন শিক্ষক। তবে গণিতের শিক্ষক হাবিব স্যার আমাকে চিনতে পারলেন।
শিক্ষকদের মধ্যে আমার ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ দেখা গেল না। কিন্তু হাবিব স্যার বেশ আগ্রহ নিয়েই জানতে চাইলেন- আমি পড়ালেখা কতদূর করেছি, এখন কী করছি ইত্যাদি। আমি তাকে বললাম, আমি ডেনমার্ক টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট করেছি। আমি ডেনমার্কের নাগরিকত্বও পেয়েছি। হাবিব স্যার যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর তিনি উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলী আমি আপনাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমার সামনে যিনি বসে আছেন তিনি আমাদের সাবেক ছাত্র সাদ্দাম। তিনি ডেনমার্ক টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করছেন। তিনি ডেনমার্কের নাগরিকত্বও পেয়েছেন। আমার জানামতে এই কুতুবপুর হাই স্কুলের সাবেক ছাত্রদের মধ্যে সাদ্দামই একমাত্র ছাত্র যে বিদেশ থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছে। সে আমাদের স্কুলের গর্ব। সবাই যেন এবার নড়েচড়ে বসল। বিস্ফারিত নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হল এরকম খবর জীবনে তারা কখনও শুনেনি।
হাবিব স্যার আমাকে নিয়ে হেড টিচারের কক্ষে গেলেন। হেড টিচার সব শুনে যারপরনাই আনন্দিত হলেন। শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিকভাবে নির্দেশ পাঠালেন সবাই যেন হলরুমে চলে আসে। আমাকে বললেন, তোমার মত একজন সফল শিক্ষার্থীর সাথে পরিচিত হয়ে তারা গর্ববোধ করবে এবং তোমার মুখ থেকে মূল্যবান কিছু কথা শুনে তারা অনুপ্রাণিত হবে।
আমার জন্য আজকের দিনটা এমনিতেই অত্যন্ত কষ্টের একটা দিন। দু দু’জন আপনজন হারানোর তীব্র শোক আমার হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে রেখেছে। কিন্তু সেকথা তাদেরকে কীভাবে বলি? এ অবস্থায় আমি কীভাবে অনুপ্রেরণামূলক কথা বলি? অগত্যা হলরুমে গেলাম। ছাত্রদের সাথে আমার অভিজ্ঞতার কথা, কষ্টের কথা, পরিশ্রম কীভাবে মানুষের সাফল্যের সিঁড়ি হতে পারে তা তাদেরকে বললাম। ছাত্রদের মাঝে তুমুল উত্তেজনা। তাদের প্রতিক্রিয়া- এরকম জ্ঞানী মানুষের সাথে জীবনে তাদের প্রথম পরিচয়। তাদের একজন সতীর্থের এরকম সফলতায় তারা অত্যন্ত গর্বিত ইত্যাদি ইত্যাদি।
হাবিব স্যার আমার পিছে লেগে রইলেন। তার অনুসন্ধিৎসু মনের জানার তৃষ্ণা তখনও নিবারণ হয়নি। যে ছেলের দেশেই মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, দেশেই যার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়, সেই ছেলে কীভাবে ডেনমার্কের মত দেশ থেকে ইন্জিনিয়ারিং পাশ করে পিএইচডি করতে পারে? সেটা তার মাথায় কোনভাবেই কাজ করছে না। আমাকে বললেন, সাদ্দাম কীভাবে তুমি এ অসাধ্য সাধন করলে?
-সব আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা স্যার।
-আমাকে বলতেই হবে সাদ্দাম, কীভাবে তুমি অসম্ভবকে সম্ভব করেছে?
-আপনি আমার পারিবারিক অবস্থা সবই জানেন স্যার। আমার মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের দিনই আমি কুতুবপুর ছেড়ে চলে যাই জামালপুরে। সেখান থেকে ট্রেনে উঠে যাই ঢাকায়। ঢাকায় আমার পরিচিত কেউ ছিল না। প্রথমদিন কমলাপুর রেলস্টেশনেই কাটাই। দ্বিতীয় দিন রেল স্টেশন থেকে বের হয়ে দেখি একদল লোক কোদাল, বেলচা, কোণী নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারলাম তারা শ্রমিক। আমিও তাদের সাথে দাঁড়িয়ে গেলাম। বুড়োমত একলোক আমাকে বলল, তুমি কাম (কাজ) করবা? আমি বললাম, কাজ করব কিন্তু আমার তো হাতিয়ার কিছু নাই। তিনি বললেন, অসুবিধা নাই ম্যানেজ হয়ে যাবে চল। আমি তাদের সাথে রাজমিস্ত্রীর কাজে যোগ দিলাম। তাদের সাথে কাজ করি তাদের সাথেই এক ছাপড়া ঘরের মেঝে থাকি। পনের-বিশ দিন এভাবে কেটে যায়। যেখানে কাজ করতাম তার পাশের বাসার দারোয়ান এসে একদিন বলল, আপনাদের মধ্যে লেখাপড়া জানা কেউ আছে? বুড়ো সর্দার বলল, কেন কী দরকার? দারোয়ান বলল, বিদেশ থেকে ছোট সাহেব এসেছেন। তার সাথে সাথে থাকার জন্য একজন কাজের লোক দরকার। তবে তাকে লেখাপড়া জানতে হবে। বেতন এই কাজের সমানই পাবে তবে থাকা খাওয়ার সুবিধা আছে। বুড়ো বলল, আছে। তিনি আমার দিকে ইশারা করলেন। দারোয়ান আমাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে মেম সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মেম সাহেব কোনকিছু জিজ্ঞেস করলেন না। পরের দিন থেকে কাজ শুরু করতে বললেন।
পরের দিন সেই বাড়িতে হাজির হলাম। আমাকে নিচতলায় একটা রুমে থাকতে দেয়া হল। ছোট সাহেবের সাথে ঘুরাঘুরি করা, তার ক্যামেরা, মোবাইল সেট, পানির বোতল বহন করা ছিল আমার কাজ। তিনি আমার কাজে-কর্মে খুব খুশি হলেন। আমাকে ভাল কিছু শার্ট-প্যান্ট, জুতা-মোজা কিনে দিলেন। নতুন পোশাকে আমাকে ছোট সাহেবের ভাইয়ের মত লাগছিল। যেখানেই যাই সেখানেই ছোট সাহেবকে লোকজন জিজ্ঞেস করে, আমি তার ছোট ভাই কিনা? নামেও কিছুটা মিল আছে। আমার নাম সাদ্দাম এবং তার নাম সাজ্জাদ। এক পর্যায়ে ছোট সাহেবও বলা শুরু করলেন- হ্যাঁ, সাদ্দাম সাজ্জাদের ছোট ভাই।
যেদিন এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হল সেদিন আমি ছোট সাহেবকে বললাম, স্যার আপনার ল্যাপটপে একজনের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দেখা যাবে? তিনি বললেন, অবশ্যই দেখা যাবে, তুই ডিটেলস বল। আমি ডিটেইলস বললাম। তিনি বললেন, রেজাল্ট শিটে তো দেখি তোর নাম। আমি বললাম, হ্যাঁ ছোট সাহেব ওটা আমারই রেজাল্ট। তিনি বললেন, এতদিন তুই বলিসনি কেন? তুই তো দেখি দুর্দান্ত ছাত্র। যা, এখনই বাইরে থেকে পাঁচ কেজি মিষ্টি নিয়ে আয়। তিনি মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।
আমি মিষ্টি নিয়ে আসলাম। ছোট সাহেব মিষ্টি নিয়ে মেম সাহেবের ঘরে আমাকে নিয়ে গেলেন। মেম সাহেবকে বললেন, মা আমার ছোট ভাইয়ের এসএসসি পাশের মিষ্টি। তোর কোন ছোট ভাই? ছোট ভাই সাদ্দাম। সাদ্দাম এসএসসি পাশ করেছে। দুর্দান্ত রেজাল্ট করেছে। জিপিএ পাঁচ পেয়েছে। মেম সাহেব খুবই অবাক হলেন। ছোট সাহেব বললেন, মা, তুমি নিজের হাতে সাদ্দামকে মিষ্টি খাইয়ে দাও। মেম সাহেব নিজের হাতে আমাকে মিষ্টি খাওয়ালেন। আমি তাঁর পা ছুয়ে সালাম করলাম। ছোট সাহেব বাসার সকলকে নিজ হাতে মিষ্টি খাওয়ালেন। মেম সাহেবকে বললেন, সাদ্দামকে ভাল একটা কলেজে সায়েন্সে ভর্তি করাতে হবে। যাতে সে ডেনমার্কে গিয়ে ইন্জিনিয়ারিং পড়তে পারে, আর আমার সাথে কাজ করতে পারে।
আমার কপাল খুলে গেল। আমি মেম সাহেবকে মা ডাকা শুরু করলাম। বাসার কাছে বিয়াম কলেজে ভর্তি হলাম। এইচএসসিতেও ভাল রেজাল্ট হল। আমি আইটিএলটিএস পরীক্ষা দিলাম। ভাল স্কোর হল। আমি ডেনমার্ক টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। খুবই ভাল রেজাল্ট করে গ্র্যাজুয়েশন এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করলাম। তারপর সিটিজেনশিপ কনফার্ম করার জন্য পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হয়ে পিএইচডিও শেষ করি। এবার দেশ থেকে ফিরে গিয়ে ইউনিভার্সিটিতেই জয়েন করব।
হাবিব স্যার তন্ময় হয়ে আমার কথা শুনে গেলেন।
এই ফাঁকে একটি মেয়ে আমাদের সামনে চলে এল। হাবিব স্যার বললেন, সাদ্দাম এই মেয়েটির নাম সখিনা। সে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিবে। সখিনা নামটি শোনার সাথে সাথে আমার ব্রেনে যেন টং করে একটি আওয়াজ হল। হাবিব স্যার বলতে লাগলেন- তার বাবা ঢাকা শহরে কাজ করতে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে। তার মা ঝিয়ের কাজ করে। আমি সখিনাকে মাঝে মাঝে সহযোগিতা করি। আমার সহযোগিতায় সে এ পর্যন্ত এসেছে। খুবই ভাল ছাত্রী। তবে তার এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের টাকাটা এখনও যোগাড় হয়নি। সখিনা সে কথা শুনে মাথা নিচু করে চোখ মুছতে লাগল। আমি আমার মানিব্যাগ বের করে পনের হাজার টাকা হাবিব স্যারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, টাকাগুলো সখিনার জন্য। যখনই প্রয়োজন হবে দয়া করে আমাকে জানাবেন। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে বললাম, এ তোমার কেমন খেলা? আমার দেনা পরিশোধের ব্যবস্থা তুমি এভাবে করলে! লেখক: উপ-প্রধান (উপ-সচিব) পরিকল্পনা কমিশন, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
Posted ১১:০২ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২৫ জুলাই ২০২১
dainikbanglarnabokantha.com | Romazzal Hossain Robel
এ বিভাগের আরও খবর
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।