আল মাসুদ লিটন | মঙ্গলবার, ০৮ জুন ২০২১ | প্রিন্ট
বাংলাদেশের একটি আলোচিত ও আলোড়িত ঘটনাকে নিয়ে ২০০৪ সালে বাংলাদেশ এবং ভারত চলচিত্র একটি সিনেমা নির্মাণ করেছে। সিনেমাটির নাম খায়রুন সুন্দরী। এ সিনেমায় দেখানো হয়েছে গ্রামীণ গৃহবধূ খায়রুন সুন্দরীকে তার স্বামী ফজলুল হক ওরফে ফজল পারিবারিক কলহের জেড়ে গলায় কলসি বেধে নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করে। আরও দেখানো হয়েছে তাদের একমাত্র ছেলেকে বিস্কুটে বিষ মাখিয়ে খাইয়ে মেরে ফেলে। বাস্তবে তা ঠিক নয়। আসলে গৃহবধূ খায়রুনের মৃত্যু হয়েছিল দুর্ঘটনাজনিত! এবং তার কোনো ছেলেকে হত্যা করা হয়নি। তাদের ৫টি ছেলে এখনও বেঁচে আছেন। ৫৩ বছর পর সেই ঘটনার সত্যতা উন্মোচন হলো। মরহুমা খায়রুন এর বড় ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা, এড. খায়রুল ইসলাম (৭০) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাজনীত কারণে তার পূর্বপুরুষদের সামাজিভাবে ও রাজনৈতিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন ও তাদের প্রতি জনমনে ঘৃণার জন্ম দিতেই তার মায়ের মৃত্যুর ঘটনাটি অতিরঞ্জিত করে জনস্বাপেক্ষে তুলে ধরা হয়েছে। রোববার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সহচর, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে জামালপুর -১ আসন থেকে নির্বাচিত সাবেক এমপি, মরহুম দেলোয়ার হোসাইন সম্পর্কিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি উপরের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি আরও জানান, তারা পাকিস্তান পিরিয়ড থেকেই রাজনৈতিক পরিমন্ডলের মানুষ। তার দাদা মরহুম আইজ উদ্দিন ছিলেন মুসলিম লীগ বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের সৈনিক। সেই সময়ে তিনি জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ থানার বড়খাল গ্রামের সাড়ে ৩শ বিঘা জমির মালিক। এছাড়া দেওয়ানগঞ্জ বাজারের বড় ব্যবসায়ী। হারুন বিড়ি নামে একটি বিড়ির কারখানাও ছিল তাদের। তার দাদার ছিল দুই ছেলে। একজন ফজলুল হক অন্যজন দেলোয়ার হোসাইন।
বৃটিস থেকে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর যখন আইয়ূব খান ও ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচন হয়েছিল সেনির্বাচনে তার বাবা ফজলুল হক ছিলেন পাকিস্তান সম্মিলিত বিরোধী দলের দেওয়ানগঞ্জ থানার আহবায়ক। এই রাজনৈতিক কারণেই তৎকালিণ দেওয়ানগঞ্জের জনৈক প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতার সাথে তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছিল। সেই প্রতিদ্বন্দ্বীতাকে প্রতিহিংসায় রূপান্তর করতেই তার মা খায়রুন বেগমের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুকে হত্যা হিসেবে প্রচার প্রসার করতেই কাল্পনিক রং চুন লাগানো হয়েছে। ঘটনার প্রথমে দিকে কবিতা আকারে কাগজে ছেপে হাট বাজারে বিক্রি করা হয়েছে। পরে স্থানীয় বয়াতীদের দিয়ে জারি সারি গাওয়ানো হয়েছে। এখানেই তিনি ক্ষান্ত হননি পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার নানা আজগর আলী মাষ্টারকে দিয়ে আদালতে মামলাও করিয়েছিলেন। এব্যাপারে কালের স্বাক্ষী, দেওয়ানগঞ্জ পৌর এলাকার আরেক মুক্তিযোদ্ধা, মোঃ নুরুল ইসলাম (৭৫) বলেন, তখন ফজল হক দেওয়ানগঞ্জের বড় ব্যবসায়ী। তাদের অন্যান্য ব্যবসার ন্যায় ছিল বিড়ির ব্যবসাও।
ওই সময়ে সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে দেওয়ানগঞ্জের বড়খাল গ্রামের আইজ উদ্দিনের বড় ছেলে ফজল হক বিয়ে করেন বকশিগঞ্জের মেরুর চর গ্রামের আজগর আলী মাষ্টারের মেয়ে খায়রুনকে। খায়রুন দেখতে ছিলেন খুব সুন্দরী। তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল সুখের। বৈবাহিক জীবনে তাদের ৫টি ছেলে ও একটি মেয়ের জন্ম হয়। মেয়েটি শৈশবেই মারা যায়। বেঁচে থাকে ৫ ছেলে। জীবনের বহমান স্রােতধারায় ৬৮ সালের মাঝা মাঝি সময়ে দাম্পত্য কলহের জেড় ধরে হাতাহাতির এক পর্যায়ে খায়রুন মারা যায়। এ ঘটনায় দেশ স্বাধীন হলে জামালপুর আদালতে মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে মর্মে মামলা করেন খায়রুনের বাবা আজগর আলী মাষ্টার। সে মামলায় ফজলুল হক নির্দোষ প্রমাণিত হন। এর দুই এক বছর পর ফজলুল হক সখিনা নামের একজন বিয়ে করেন। এদিকেও তার আরও চার ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে।
মরহুম খায়রুন এর ছোট ছেলে মোঃ ফখরুল ইসলাম (৬০) মায়ের সম্পর্কে, ১৯৬৮ সালের ৩০ জনু তার মা মারা গেছেন। তিনি চাচী জেঠিদের কাছে শুনেছেন তার মা শুধু দেখতে সুন্দর ছিলেন না। তার মন মানসিকতাও ছিল উদার। তিনি পাড়া প্রতিবেশি ও দুঃখি জনের উপকার করতেন। বাবা ফজলুল হক ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কায় যাওয়ার পর সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ৯২ বছর বয়সে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। ফজলুল হকের দ্বিতীয় স্ত্রী সখিনা হক (৭১) তার স্বামী শেষ স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে জানান, তার স্বামী হজ্জে যাওয়ার প্রাক্কালে তাকে নসিহত করে গিয়েছিলন যে, হজ্জে যাওয়ার পর যদি তার মৃত্যু হয় তাহলে যেন তাকে সেখাই সমাহিত করা হয়। সেজন্য তার মৃত্যুর পর লাশ আর দেশে আনা হয়নি। আলোড়িত এই ঘটনার বিখ্যাত দুই পাত্র পাত্রী পৃথিবী থেকে চলে গেলেও রয়েগেছেন দেশ বিদেশের লাখো মানুষের মনের মণিকোঠায়। মরেও তারা রয়েছেন অমর।
Posted ২:৪৭ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৮ জুন ২০২১
dainikbanglarnabokantha.com | Romazzal Hossain Robel
এ বিভাগের আরও খবর
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।