বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৪ আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

>>

করোনায়ও বৈশাখের আহবান

  |   বুধবার, ১৪ এপ্রিল ২০২১   |   প্রিন্ট

করোনায়ও বৈশাখের আহবান

॥ নূরুদ্দীন দরজী ॥
আবহমান কালের বাঙালির প্রাণের মেলা বৈশাখ আজ করোনায় মলিন। বাঁধাগ্রস্ত এ মরণব্যাধি ছোবলে। শত শত বছরের প্রাণের স্পন্দন স্তিমিত হয়ে পড়েছে আজ। সবকিছুই যেন প্রাণহীন।কারণ সবার আগে জীবন বাঁচাতে হবে। বাঁশি আছে বাজে না। সুর উঠে থেমে যায়, তাল নেই। এমন তো হবার কথা ছিল না। নিষ্ঠুর মহামারি শেষ করে দিতে চাচ্ছে সব।
বৈশাখ বাঙালির আশার প্রতীক এবং ভালোবাসার অনুরাগ। বাংলা ক্যালেন্ডারে আমাদের প্রথম মাস বৈশাখ। এ মাস সাংস্কৃতিক উৎসবের মাস। আমাদের মত পৃথিবীর অনেক জাতিরও নববর্ষ আছে। রয়েছে নববর্ষের আনন্দ। পুরাতনকে ধুয়ে মুছে নববর্ষের আনন্দে অবগাহন করে তারা। বাঙালিরাও সেই আদি হতে করে মহা ধুমধামের সাথে। রবী ঠাকুরের বহুল জনশ্রুত গানটি বাঙালির জন্য নববর্ষের বাণী বহন করে আনে। এ গানের আবির্ভাব নির্জীব জীবনকে তাড়িত করে। আনে নতুনের আস্বাধন। এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ। তাপস নিস্বাস বায়ে মুমুর্ষরে দাও উড়ায়ে । ব্ৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। এখানে পুরাতনকে বিসর্জন দিয়ে আছে নতুনকে আহ্বানের ডাক। অর্থের এবং সমযয়ের কিছুটা পার্থক্য থাকলে ও পুরাতনকে বর্জন করে নতুনের আহবান অন্যান্য জাতিতে ও দেশ দেশে রযয়েছে। শীতে দুঃখ কষ্টের অবসান হয়ে নব সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে জানুয়ারি মাস এলেই ইংরেজরা পায় নতুন জীবন। তাইতো কবি আলফ্রেড টেনিসন তাঁর বিখ্যাত ‘In Memoriam, KweZvq Mv‡b Mv‡b e‡j‡Qb, ‘Ring out the old, ring in the new./Ring happy bells, across the snow./The year is going, let him go,/Let ring out the false/ ring in the true. হিমবায়ুর শূন্য ডিগ্রী সেলসিয়াসের তাপমাত্রার কষ্ট শেষ ও ভেদ করে তারা এসেছে। এসেছে নতুন জানুয়রির দ্বারপ্রান্তে। -তাদের অবশ্যই পুরাতনকে ভুলে যেতে হবে। ঢুকে যেতে হবে আনন্দালোকে নতুনকে বরণে মহা ধুমধামের আনন্দে। এখানে কবি বলেছেন, যা চলে গেছে যেতে দাও। বিগত বছরের শূন্যতা পূর্ণ করে আবার এসেছে নব বর্ষ। ঠিক এভাবে ইরানীরা ২২শা মার্চ, ইহুদিরা তাদের পঞ্জিকার তেশরির প্রথম দিন যা করে সেপ্টেম্বরে ,চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ভারতে নানা অঞ্চলে তাদের নববর্ষ পালনের নিজস্থ ঐতিহ্য রয়েছে।
পৃথিবীর প্রত্যেকটি জাতির নববর্ষ আসার ইতিহাস ও রয়েছে। আমরা বাঙালি আমাদের ইতিহাস ও হাজার বছরের পুরানো। কিছু কিছু মতভেদ থাকা সত্ত্বেও জানতে পারি বাংলা সন প্রথম প্রচলন করেছিলেন রাজা শশাঙ্ক। অনেক ইতিহাসবিদদের মতে ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দ হতে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়েছিল। রাজা শশাঙ্ক অত্যাচারী রাজা ছিলেন বটে, তবও তিনি সর্বপ্রথম বাংলায় স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বাধীনতার গৌরব মন্ডিত স্মৃতি ধরে রাখার জন্যই শশাঙ্ক তাঁর রাজত্বের প্রারম্ভে বাংলা সন চালু করেন। আবার কারো কারো মতে, বিশেষ করে পুথিপাঠক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্যের মতে সুলতানী যুগে এ সন চালু হয়েছে। সে আমলে দীর্ঘ দিন বাংলা স্বাধীন ছিল। এ কারণে সুলতানী যুগেই বাংলা সন প্রচলন হয়। আবার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য হচ্ছে বাংলা সন চালু হয়েছে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে। তখন হিজরি সনের দিন তারিখ মত খাজনা আদায় করা হতো। হিজরি মাসের সাথে ঋতুর মিল থাকেনা। হিজরিতে চন্দ্র বৎসর হয় ৩৫৪দিনে যেখানে সৌর বৎসর ৩৬৫দিনে। প্রতি বছর ১১দিন করে কমে কমে সৌর বৎসরের ঋতুর সাথে পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। হিজরিতে যে সময় খাজনা আদায়ের সময় আসে সে সময়ে ঋতুকালীন ফসল পাওয়া যায়না। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি কারণে কৃষক সমাজ খাজনা দিতে পারতো না। এ অবস্থার অবসান কল্পে সম্রাট আকবর বাংলাদেশের জন্য স্বতন্ত্র দিন পঞ্জিকা তৈরি করালেন। ইংরেজি সৌর বৎসরের সাথে মিল রেখে হিজরিতে সমন্বয় করে বাংলা সন করা হলো। এ ভাবে বাংলা সন সৃষ্টি হলে আকবর ও দুটো পয়সা পেলেন এবং আমরা পেলাম একটি সন যা আজ পৃথিবীতে বাংলা সান নামে পরিচিত। সম্রাট আকবরই আমাদের জন্য সন সৃষ্টি করে আজীবনের জন্য এনে দিলেন আলাদা সংস্বৃতি ও আলাদা সত্তা। আর এটি নিয়েই আমাদের আনন্দের শেষ থাকেনা। পয়লা বৈশাখে আনে নব জাগরণ। এক সময় বাংলা নব বর্ষকে, নওরোজ উৎসব, ও বলা হতো যে উৎসব এখনো পারস্যে চালু রয়েছে। আবুল ফজলের’আইন ই আকবরী অর্থাৎ আকবরের আইন গ্ৰন্থেএর প্রমাণ আছে।
দীর্ঘ পরাধীনতার সময় পয়লা বৈশাখ আমাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করতো। শোষকের বিরুদ্ধে এ জাতীয়তাবোধ বিদ্রোহের সূত্রপাত করেছে বার বার। স্বদেশী চিন্তায় মানুষ ব্যাকুল হয়ে পড়তো। পাকিস্তানীরা আমাদের বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষাকে রোধ করতে চেয়েছে অনেক বার। তারা এটিকে হিন্দুয়ানা বলতো। বৃটিশ মুক্ত হয়ে আমরা আমাদের বাংলা সংস্বৃতি নিয়ে পাকিস্তানের খপ্পরে পড়েছিলাম। ধর্মের দোহাই তোলে পয়লা বৈশাখ, রবীন্দ্র সঙ্গীত ও বাংলা গান তারা নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু তাদের সকল অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বাঙালির লালিত মানসিকতা নিকট তারা পরাজিত হয়েছে।
আমাদের প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখ এখন জাতীয় উৎসব। নতুন হালখাতাতেই সীমাবদ্ধ নেই এ উৎসব। তখন কৃষকের গোলায় বোরো ধান উঠে। শহর বন্দরে ও পালিত হয় বড়ই ধুমধাম করে। বৈশাখ এখন বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উৎসব। ঢোলকের বাদ্যের তালে তালে এ বৈশাখ আমাদের ধমনীতে আনে নব হিল্লোল। আমাদের রক্ত হয় সঞ্চারিত। ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলো প্রসার সাজিয়ে বসে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জায়গায়। প্রাণে প্রাণে চলে মধুর মিলন। ছেলেমেয়েদের হাসি-খুশি ও আনন্দ আবদারে মাতিয়ে তোলে ঘর-বাড়ি আঙিনা। পয়লা বৈশাখের রেশ ধরে চলে সমস্ত বৈশাখ মাস। অতিথি আপ্যায়ন, আত্মীয় বাড়িতে গমন, বন্ধূদের সৌহার্দ্যে বেড়ে যায় বহুগুণে স্বয়ংক্রীয় ভাবে।
মরণব্যাধি করোনার ছোবলে যখন পুরো দুনিয়া বিষাদগ্ৰ¯, বাঙালির প্রাণের বৈশাখ হয়ে পয়েছে মলিন হতে মলিনতর। আমরা বৈশাখের ঐতিহ্যগত আনন্দ থেকে বঞ্চিত। কিন্তু মহামারিতো থামাতে পারছেনা মনের গভীরে লুকায়িত আনন্দ। আমাদের প্রাণে প্রাণে আছে সুরের উম্মাদনা। চিরাচরিত বৈশাখ মেলা আজ শুধুই বাংলাদেশ সীমাবদ্ধ নয়। ছড়িয়ে গেছে বিশ্বের সর্বত্র। যেখানেই বাঙালি বসবাস সেখানেই মেলার আবেশ।
বাংলা মায়ের সন্তানেরা যেখানেই থাকুক তার আদরের দুলাল দুলারীরীরা সেখানেই মেলানন্দে প্রসার সাজাচ্ছে। তাদের মধ্যে বেড়ে উঠছে সম্প্রীতি, সমঝোতা ও পারস্পরিক সৌহার্দ্য। সর্বত্রই বাংলা তাদের প্রাণ, বাংলা তাদের আনন্দ। শত প্রতিকূলতার মাঝেও আনন্দে রয়েছে বাংলা তথা বৈশাখ বা পয়লা বৈশাখ। এ বৈশাখের উৎসবে সব বাঙালি হয় একত্রিত। এ জন্যই বোধ হয়, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যথার্থই বলেছেন,-‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়েও বেশি সত্য আমরা বাঙালি। শত শত বছর ধরে প্রাণের স্পন্দনে আনে যে বৈশাখ সে বৈশাখ লালিত হবে বাঙালি মনে, প্রাণে ও জাগরণে। তাদের জাতীয় জীবনে। যদি আসে কখনো বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, ঝগড়াঝাঁটি বিদ্ধেশ সেসব কিছুই দূরীভূত হয়ে আমরা প্রমাণ করবো আমরা বাঙালি। আমাদের মাঝে দেখা দিবে না অসাম্য ও অসুন্দর। সকল মহামারি দূরীভূত হয়ে আবার জেগে উঠবে নতুন প্রাণ প্রত্যাশায় সবাইকে -বৈশাখের রাঙা প্রভাত- ‘শুভ নববর্ষ। লেখক: কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও)

 

Facebook Comments Box

Posted ২:০৪ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৪ এপ্রিল ২০২১

dainikbanglarnabokantha.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

রূপা
(1469 বার পঠিত)
ছোটগল্প (দেনা)
(1011 বার পঠিত)
দূর দেশ
(836 বার পঠিত)
কচু শাক চুরি
(791 বার পঠিত)
কৃষ্ণ কলি
(762 বার পঠিত)

সম্পাদক

রুমাজ্জল হোসেন রুবেল

বাণিজ্যিক কার্যালয় :

১৪, পুরানা পল্টন, দারুস সালাম আর্কেড, ১০ম তলা, রুম নং-১১-এ, ঢাকা-১০০০।

ফোন: ০১৭১২৮৪৫১৭৬, ০১৬১২-৮৪৫১৮৬

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

design and development by : webnewsdesign.com

nilüfer escort coin master free spins