রবিবার ২০ জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৫ শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

>>

ইলিশের একাল-সেকাল

টিইও নূরুদ্দীন দরজী   |   রবিবার, ২২ জুন ২০২৫   |   প্রিন্ট

ইলিশের একাল-সেকাল

ইলিশের দাম শুনে এখন শিহরিত  হতে হয়। চলতি মাসেই ইলিশের দাম নিয়ে বেশ কয়েকটি চমকপ্রদ খবর প্রকাশিত হয়েছে। যা সাধারণ মানুষের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টির মতো ঘটনা। ১৭ জুন কক্সবাজারের সেন্টমার্টিনে একটি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৫০ টাকায়।

১১ জুন মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিম বাজারে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৩০০ টাকা। ইলিশের বাড়ি বলা হয় যে চাঁদপুরকে, সেখানেই ২ কেজি ৪৮০ গ্রাম ওজনের একটি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১৩ হাজার টাকায়। এরকম আরও উচ্চ দরদামের কথা দেশের মানুষ অবশ্যই কমবেশি শুনে আসছে। ইলিশ মাছ ক্রমান্বয়ে সাধারণ ও গরিব মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো এমন আরও কত খবর শুনতে হবে।

ইলিশ নিয়ে এমন সব খবর শুনে মাত্র ২০ বছর আগের একদিনের ঘটনা মনে পড়ে গেল। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় চাকরি করি। উপজেলার দক্ষিণ প্রান্তের ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে যাই।

২০০৬ সাল। তখন বর্ষাকাল এবং দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। পরিদর্শনের নির্দেশনা মোতাবেক শ্রেণি পরিদর্শন, পাঠোন্নতি যাচাইয়ের মতো একাডেমিক কাজগুলো শেষ করে অফিসকক্ষে বসে রেকর্ডপত্রাদি নিরীক্ষণ করছিলাম। বিদ্যালয় ভবন দক্ষিণ ভিটের উত্তরমুখী। পেছনে দক্ষিণের খোলামেলা মাঠ মেঘনা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত।যেখান থেকে পূর্ব-দক্ষিণে বাঁক নেওয়া নদীর দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। বর্ষাকাল হওয়ায় দেয়াল ঘেঁষা মাঠ পানিতে সাদা হয়ে নদীর সঙ্গে একাকার হয়ে আছে। প্রয়োজনীয় কাজগুলো করছি। একই সঙ্গে দক্ষিণের দেয়ালের ছপছপানি ও ছপাৎ ছপাৎ ব্যাপক শব্দ শুনে কৌতূহলী হয়ে উঠি। প্রধান শিক্ষকের কাছে এমন হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জেলেরা খরার জাল দিয়ে মাছ ধরছেন। ’ এ কথা শুনে কৌতূহল আরও বেড়ে যায়। পরিদর্শনসংক্রান্ত কাজগুলো শেষ করে শিক্ষকরাসহ জেলেদের অস্থায়ী ডেরার কাছে যাই। পাশেই পানিতে অন্য জাল দিয়ে তারা অনেক মাছ জিইয়ে রেখেছেন, যার বেশির ভাগ ইলিশ। দেখে মন ভরে যায়। মাছের দাপাদাপি, লাফালাফি দেখে অভিভূত হয়ে পড়ি। এমন সুন্দর রুপালি ইলিশ দেখে কেনার ইচ্ছা হয়। শিক্ষকরা আমার পরিচয় দিয়ে দাম জিজ্ঞেস করলে এক জেলে বলেন, ‘টিইও সাহেবের জন্য এই ইলিশের কেজি মাত্র ২০০ টাকা। ’ একে তো জীবিত ও তাজা মাছ, মাঝারি সাইজ, দামে কম এবং সরাসরি বাড়ি আসব চিন্তা করে কয়েক কেজি কিনে নিয়েছিলাম। যে স্মৃতি আমার কাছে  স্মরণীয় হয়ে আছে। এখনো মাঝেমধ্যে ইলিশ কিনতে গেলে বর্তমানের দাম শুনে সেদিনের কথা বারবার মনে পড়ে। সেদিনে মন চলে যায়।

বর্তমান সময়ে নেই সেই ইলিশের প্রাচুর্যতা। ইলিশ এখন দুষ্পাপ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে। মাত্র ১৫-২০ বছরের ব্যবধানে ইলিশ হয়ে উঠেছে রাজকীয় মাছ। এ মাছ এখন সাধারণ তথা গরিব মানুষের নাগালের বাইরে। অনেক গ্রাম্য বাজারে ইলিশ পাওয়াই যায় না। কিছু কিছু বড় ধরনের বাজারে দুই-একটি দোকানে অনেক খোঁজাখুঁজি করে সন্ধান মেলে। কিন্তু দাম আকাশচুম্বী। অনেকের ইলিশ খেতে ইচ্ছা হলেও কিনতে গিয়ে দাম শুনে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয়। এ মাছ বাঙালির লালিত উৎসব ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে থাকলেও এখন হয়ে গেছে আভিজাত্যের বিষয়।

ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। এ মাছ নিয়ে আমরা গর্ব করি। পৃথিবীর মোট উৎপাদিত ইলিশের ৬৫ ভাগের বেশি বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। বাকি ৩৫ ভাগের ১৫ ভাগ ভারতে, ১০ ভাগ মিয়ানমারে এবং অবশিষ্ট ১০ ভাগ উৎপাদিত হয় আরব ও আটলান্টিক সাগরের তীরবর্তী দেশগুলোয়। মনে করা হয় বাংলাদেশের মাছের চাহিদার এক দশমাংস ইলিশ থেকে মেটে। আমাদের দেশে ইলিশ ধরা ও বিক্রি পেশার সঙ্গে ৪০ লাখের বেশি মানুষ জড়িত। আমাদের নদীগুলোর ভৌগোলিক গঠন এবং বঙ্গোপসাগরের উর্বর মোহনা অঞ্চল থাকায় এখানে বেশি ইলিশ উৎপাদিত হয়ে আসছে। হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। গবেষকের ধারণা, ২০ থেকে ৩০ লাখ বছর আগে এ মাছের পূর্বপুজন্মের এ গাঙ্গেয় বদ্বীপে আগমন ঘটেছিল। আমাদের যেসব নদী বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে এমন নদী পদ্মা, মেঘনা যমুনায় ইলিশ বেশি পাওয়া যায়। তবে পদ্মার ইলিশ অনেক সুস্বাদু। মাছের রাজা যেমন বলা হয় ইলিশকে, আবার ইলিশের রাজা বলা হয় পদ্মার ইলিশকে। পদ্মা নদীর পানির স্রোতের কারণে এ ইলিশে ঘন তেল হয়। আবার পদ্মার পানিতে খনিজ অক্সিজেন বেশি থাকায় জিনগত পার্থক্য দেখা যায়। এ ছাড়া কিছু কিছু নদনদী যেমন তেঁতুলিয়া, ধলেশ্বরী, পায়রা, আড়িয়াল খাঁ, কীর্তনখোলা, ভৈরব, রূপসা, সুরমা ও কুশিয়ারার যে অংশে বা জলধারায় মিঠাপানি ও লবণাক্ততার সংমিশ্রণ ঘটে, সেসব পানিতে ভিন্ন স্বাদের ইলিশ পাওয়া যায়। –লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক 

Facebook Comments Box

Posted ১২:৩০ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

dainikbanglarnabokantha.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

রূপা
(1677 বার পঠিত)
ছোটগল্প (দেনা)
(1144 বার পঠিত)
দূর দেশ
(1096 বার পঠিত)
কচু শাক চুরি
(974 বার পঠিত)
কৃষ্ণ কলি
(961 বার পঠিত)

সম্পাদক

রুমাজ্জল হোসেন রুবেল

বাণিজ্যিক কার্যালয় :

১৪, পুরানা পল্টন, দারুস সালাম আর্কেড, ১১ম তলা, রুম নং-১১-এ, ঢাকা-১০০০।

ফোন: ০১৭১২৮৪৫১৭৬, ০১৬১২-৮৪৫১৮৬, ০২ ৪১০৫০৫৯৮

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

design and development by : webnewsdesign.com

nilüfer escort coin master free spins